বর্তমান সময়ের আলোচিত ও মর্মস্পর্শী ঘটনা দুর্ঘটনা। বাংলাদেশে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় জীবন খাতা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ। মূল্যবান জীবনের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে সম্পদ, ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে হাজারো স্বপ্ন। দুর্ঘটনায় হাজারো পরিবার উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পথে বসছে।
করোনা সংক্রমণ রোধে প্রায় দুই মাস গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও ২০২১ সালে সড়ক, নৌ ও রেলপথে ৪ হাজার ৯৮৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ৬৮৯ জন। আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৮০৫ জন।
শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আয়োজিত ‘২০২১ সালের সড়ক দুর্ঘটনা পরিসংখ্যান উপস্থাপন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান নিসচা’র চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।
তিনি জানান, টেলিভিশন চ্যানেল ও ১১ টি জাতীয় দৈনিকে প্রচারিত ও প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
এ পরিসংখ্যান ও প্রতিবেদনের কাজটি করা হয়েছে পুরোপুরি সেকেন্ডারি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। এছাড়াও অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও শাখা সংগঠনগুলো থেকেও তথ্য নেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানের শুরুতে নিহতদের প্রতি শোক জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার প্রকারভেদে দেখা যায়, সড়ক পথে ৩ হাজার ৭৯৩টি দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ২৮৯ জন নিহত ও ৫ হাজার ৪২৪ জন আহত; রেল পথে ২৭০টি দুর্ঘটনায় ২৫৪ জন নিহত ও ৪২ জন আহত; নৌ পথে ৯০টি দুর্ঘটনায় ১৯৮ জন নিহত, ১৮৬ জন নিখোঁজ ও ৩৩৯ জন আহত; অপ্রকাশিত তথ্যে প্রায় ৮৩০টি দুর্ঘটনায় ৯৪৮ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তির পর ও হাসপাতাল থেকে রিলিজের পর আনুমানিক ২০ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে।
৩ বছরের সড়ক দুর্ঘটনার চিত্রে দেখা গেছে, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার ৯৮৩টি। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালের সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি হয়েছে ৮৯১টি। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার ৭০২টি। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালের সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কম ৬১০টি। কিন্তু এবারে ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালের সড়ক দুর্ঘটনা বেশি লক্ষণীয়। যা ২০২০ সালের দুর্ঘটনার অনুপাত থেকে ২১ শতাংশ বেশি।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশেও এর ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে অফিস-আদালত, দোকানপাট ও গণপরিবহন বন্ধ থাকে। মূলত ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কম হওয়ার কথা তারপরও আগের বছরের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হওয়াটা উদ্বেগের বলছে সংগঠনটি।
২০২১ সালে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে— সড়কের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাব, টাস্কফোর্সের ১১১টি সুপারিশনামা বাস্তবায়ন না হওয়া, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা, দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালনা করা, লাইসেন্স ছাড়া চালক নিয়োগ, পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ওভারটেকিং করা, বিরতি ছাড়াই দীর্ঘসময় ধরে গাড়ি চালনা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালনা বন্ধে আইনের প্রয়োগ না থাকা, সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি বৃদ্ধি, মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, একই রাস্তায় বৈধ ও অবৈধ এবং দ্রুত ও শ্লথ যানবাহন চলাচল, রাস্তার পাশে হাটবাজার ও দোকানপাট থাকা।
করোনা সংক্রমণ রোধে প্রায় দুই মাস গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও ২০২১ সালে সড়ক, নৌ ও রেলপথে ৪ হাজার ৯৮৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ৬৮৯ জন। আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৮০৫ জন।
এদিকে একইদিনে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২১ সালে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৬ হাজার ২৮৪ জন নিহত ও ৭ হাজার ৪৬৮ জন আহত হয়েছেন। শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে এ পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই তালিকা তৈরি করেছেন তারা।
সংস্থাটি জানায়, নিহতদের মধ্যে ৩৫.২৩ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এ ছাড়াও নিহতদের মধ্যে ৩৪.২৪ শতাংশ পথচারী এবং ১২.৬৯ শতাংশ চালক ও হেলপার ছিলেন।
গত বছর ৭৬টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৫৯ জন নিহত, ১৯২ জন আহত এবং ৪৭ জন নিখোঁজ রয়েছেন। একই সময়ে ১২৩টি ট্রেন দুর্ঘটনায় অন্তত ১৪৭ জন নিহত ও ৩৯ জন আহত হয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনকে সঠিকভাবে কার্যকরের বিকল্প কিছু নেই। আমাদের নিজেদের স্বার্থে সড়কে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর যেন একটি মূল্যবান প্রাণও সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে না যায়। একজন মায়ের বুকও যেন খালি না হয়। একজন নারীও যেন বিধবা না হয়। কোনো সন্তান যেন এতিম না হয়। আমাদের যেমন নিরাপদ সড়ক পাওয়ার অধিকার আছে, তেমন কিছু কর্তব্যও আছে। পথচারী, মালিক, চালক, হেলপার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজ নিজ জায়গায় থেকে সৎভাবে কর্তব্যগুলো পালন করে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াল অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারি। নিজ দায়িত্বে সচেতন হয়ে সুস্থ থাকি, অন্যকে এবং পরিবারকে নিরাপদ রাখি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবতা হচ্ছে সড়কে প্রাণ যাওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না। সরকারের নানা বিভাগ, একেকজন একেক দিকে। কেউ সঠিক ভাবনা ভাবছে না। তাই যা হবার তাই হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুই যেন আমাদের নিয়তি হয়ে উঠছে। সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া চালক ও বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে আনা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে কে?
তারা বলেন, দিনের পর দিন এ অবস্থা তো চলতে পারে না। এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র মুখ বন্ধ করে থাকতে পারে না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সড়ক দুর্ঘটনার মূল অনুষঙ্গ বেপরোয়া গতি। চালকেরা বেপরোয়া গতিতে এবং একের পর এক পাল্লা দিয়ে যান চালানোর কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।
তারা বলেন, মহাসড়কে গড়ে প্রতি মিনিট পরপর একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে ওভারটেকিংএর চেষ্টা করে। একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে পাশ কাটাতে গেলেই দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়। এটি প্রতিরোধে মহাসড়কে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। সড়কে শৃঙ্খলা নেই বলেই দুর্ঘটনা। আর সরকারের পক্ষ থেকে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগও খুব একটা চোখে পড়ে না। সড়ক নিরাপত্তা শুধু মুখেমুখেই। বাস্তবে কর্মসূচি নেই বললেই চলে।
তারা বলেন, আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। এ ক্ষেত্রে সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশসহ চলমান প্রশাসন এ আইন প্রয়োগে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে তাদের ঢেলে সাজাতে হবে, অন্যথায় নতুন করে দুর্ঘটনা রোধে বিশেষ বাহিনী গঠন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৩
আপনার মতামত জানানঃ