মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলার পরিকল্পনা অনেক সময় ত্রুটিপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নেওয়া হয়ে থাকে। এমনকি ভুল লক্ষ্যবস্তুতে ড্রোন হামলা চালানো হয়ে থাকে।
আর এতে হতাহত হয় বেসামরিক মানুষ। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের গোপন নথিতে এমনটাই জানানো হয়েছে। খবর আল জাজিরার।
পেন্টাগনের গোপন নথি অনুযায়ী, এসব ‘ভুল হামলায়’ গত এক দশকে মধ্যপ্রাচ্যে ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। সূত্র মতে, পেন্টাগনের গোপন নথির ভিত্তিতে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বিমান হামলার কয়েকটি ঘটনা তদন্ত করছিল নিউইয়র্ক টাইমস। তা করতে গিয়েই এই বিষয়ে পেন্টাগনের গোপন কিছু নথি সংবাদমাধ্যমটির হাতে আসে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি ঘটনাতেও ভুল স্বীকার বা কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। অল্প কিছু ঘটনায় নিহতের স্বজনদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।
যা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে
যদিও গত পাঁচ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে মার্কিন বাহিনী যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় ৫০ হাজারের বেশি হামলা চালিয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে সিরিয়ার প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে আলোচনা করা হয়েছে। ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ড্রোন হামলা চালিয়ে ৮৫ জন ইসলামিক স্টেট (আইএস) যোদ্ধাকে হত্যার দাবি করে মার্কিন বাহিনী।
কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, সেই হামলায় প্রাণ গেছে ১২০ জনের বেশি মানুষের। নিহতদের সবাই ছিলেন নিরীহ গ্রামবাসী।
একই ঘটনা ঘটেছে ইরাকেও। ২০১৭ সালে ইরাকের পশ্চিম মসুলে মার্কিন বিমান থেকে একটি গাড়ি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয় মার্কিন বাহিনীর দাবি অনুযায়ী, গাড়িটিতে বোমা ছিল।
কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধান বলছে, সেই তথ্য সঠিক ছিল না। হামলার সময় গাড়িটিতে মাজিদ মাহমুদ আহমেদ নামের এক ব্যক্তি, তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান ছিলেন। হামলায় তাঁরা সবাই নিহত হন। প্রাণ যায় আরও তিনজন বেসামরিক ব্যক্তির।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আইএসের বিরুদ্ধে বোমা হামলায় মার্কিন বাহিনী বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষার বিষয়টি নিয়মিতভাবেই পাশ কাটিয়ে গেছে। গত আগস্টে আফগানিস্তানের কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন হামলা চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা করে।
পেন্টাগন থেকে শুরুতে দাবি করা হয়েছিল, তারা বোমা বহনকারী একটি গাড়িতে হামলা চালিয়েছে। তবে নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, নিহত ১০ জন বেসামরিক মানুষ। একই পরিবারের সদস্য।
এই বিষয়ে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের মুখপাত্র ক্যাপ্টেন বিল আরবান নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কিছু ভুল রয়ে যেতে পারে। এটা ঘটে থাকে অসম্পূর্ণ কিংবা ভুল গোয়েন্দা তথ্যের কারণে।
আগামী দিনগুলোয় আরও কার্যকর উপায়ে হামলা পরিচালনায় আমরা এসব ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চাই। কেননা প্রতিটা জীবনই অমূল্য।
উল্লেখ্য, ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধরত মার্কিন সেনাদের মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় তুমুল সমালোচনার মুখে পড়তে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে মধ্যপ্রাচ্যে বিমান হামলা ব্যাপকতা পায়।
ধীরে ধীরে দেশগুলো থেকে সেনা কমিয়ে ড্রোন হামলা বাড়িয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বারাক ওবামা এসব বিমান হামলাকে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে নিখুঁত অভিযান’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলেও এসব হামলা অব্যাহত ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঔপনিবেশ
নানা অছিলায় মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের নামে বিভিন্ন দেশে সৈন্য পাঠায় আমেরিকা। এরপর দশকের পর দশক কেটে যায় কিন্তু সৈন্যরা আর নিজ দেশে ফেরেন না। ইরাক থেকে তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি।
আছে হাজারো সৈন্য। ইরানের হুমকির পর এই ঘাঁটিগুলোতে ‘হাই অ্যালার্ট’ জারির পাশাপাশি বাড়তি সৈন্য পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে পেন্টাগন। যেসব দেশে মার্কিন সেনারা আছে তা দেখা যাক।
ইরাক: ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের কত সৈন্য রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায় না। তবে গ্রিন জোন, বাগদাদের কূটনৈতিক এলাকা, আল আসাদ বিমান ঘাঁটিতে বর্তমানে দেশটির সেনাসদস্য রয়েছে। যার সংখ্যা আনুমানিক ছয় হাজার হতে পারে।
কুয়েত: মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র কুয়েত। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা সহায়তা চুক্তি। দেশটিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি মার্কিন ঘাঁটি। যেখানে ২০২০ সালে প্রায় ১৩ হাজার সৈন্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের।
সিরিয়া: ২০১১ সালে সিরিয়ায় বিদেশি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা তাণ্ডব শুরু করার পর উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আমেরিকা ও তার মিত্র কয়েকটি দেশ সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালায়। আফগানিস্তানের পর এবার সিরিয়ার তিনটি ঘাঁটি থেকে মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহার করেছে ওয়াশিংটন।
২০২০ সালের অক্টোবরে সেখান থেকে সেন্য প্রত্যাহার শুরু করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। তার আগ পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় ২০০০ সৈন্য ছিল।
জডার্ন : ইরাক, সিরিয়া, ইসরায়েল, আর সৌদি আরবের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে জর্ডানের। দেশটিতে বিমান ঘাঁটি রয়েছে আমেরিকার।
সৌদি আরব: সৌদি আরবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন হাজার সেনা সদস্য রয়েছে। সৌদি তেলক্ষেত্রে হামলার পর ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সংঘাতের শঙ্কায় সেখানে আরও সৈন্য পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে তারা।
বাহরাইন: বাহরাইনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি নৌ-ঘাঁটি রয়েছে। বর্তমানে সেখানে কয়েক হাজার মার্কিন সৈন্য রয়েছে।
ওমান: ওমানের অবস্থান হরমুজ প্রণালীর কাছে আরব উপকূলে, যা জ্বালানি পরিবহনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ। বর্তমানে সেখানে ৬০০ মার্কিন সৈন্য রয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত: হরমুজ প্রণালীর পাশে থাকা আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেখানে পাঁচ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে পেন্টাগন।
কাতার: মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটিটি কাতারের আল উদিদে। এর আধুনিকায়নে ২০১৮ সালে ১৮০ কোটি ডলারের একটি প্রকল্প ঘোষণা করে কাতার। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ হাজার সৈন্য নিযুক্ত ছিল।
তুরস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য রয়েছে তুরস্কেও। দেশটির ইনজিরলিক বিমান ঘাঁটিসহ বেশকিছু জায়গায় ২০২০ সালে প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান কর।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ