২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর প্রথমবারের মতো এই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল, ফলে সে বিবেচনায় ২০১৮ সালের এই জাতীয় নির্বাচনের একটা ভিন্ন দিক ছিল। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নিয়ন্ত্রিত এবং একচেটিয়াভাবে নির্বাচন করার অভিযোগ ওঠে এই নির্বাচনকে ঘিরে। এখানে প্রশ্ন এবং অভিযোগের পাল্লা অনেক ভারী হয়।
তবে অনেক প্রশ্ন এবং অভিযোগের মুখেও টানা তৃতীয় বার সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি মাত্র সাতটি আসন পেয়ে শেষ পর্যন্ত সংসদে গেছে। এই নির্বাচনকে অগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উত্থানের পক্ষে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়।
ভোটের আগের রাত
ভোটের দিন সারাদেশে সব ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু অনেক নির্বাচনী এলাকা থেকে বিএনপি এবং তাদের জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বেশ কিছু প্রার্থী ভোটের আগের রাতেই ভোটকেন্দ্র নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে নানা অভিযোগ তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন।
তাদের অভিযোগ ছিল, রাতেই বিভিন্ন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটের প্রার্থীর সমর্থকেরা ব্যালট পেপারে সিল মেরেছে।
প্রায় সারারাতই বিরোধী প্রার্থীরা বিভিন্ন মিডিয়ায় টেলিফোন করে এমন অভিযোগ করছিলেন। তবে আগের রাতে সিল মারার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশনও এমন অভিযোগ মানতে রাজি হয়নি।
ভোটের সকাল
ভোট শুরুর আগের মুহুর্তে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের একটি কেন্দ্রে বিবিসি বাংলার সাংবাদিকের ক্যামেরায় ধরা পড়ে ব্যালট ভর্তি বাক্স। চট্টগ্রাম-১০ আসনের শহীদ নগর সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে এই ঘটনা ঘটে।
ভোট গ্রহণের প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে সকাল ৭টা ৫৪ মিনিটে ঐ কেন্দ্রে বিবিসি’র সাংবাদিক দেখতে পান, বিভিন্ন বুথে ব্যালট বাক্স নেয়া হচ্ছে। ভোট শুরুর নির্ধারিত সময় ছিল সকাল ৮টা। কিন্তু ওই কেন্দ্রে বিবিসির সাংবাদিক যেসব ব্যালট বাক্স দেখেছেন, সেগুলো ছিল ব্যালট পেপার দিয়ে ভরানো।
বিবিসি’র সাংবাদিক কেন্দ্রটির প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে গিয়েও ব্যালট ভর্তি বাক্স দেখতে পান। তিনি তার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ব্যালট ভর্তি বাক্স কেন্দ্রের বুথে নেয়ার দৃশ্য ধারণ করেছিলেন।
চট্টগ্রামের সেই ভোটকেন্দ্রের বাইরে কিন্তু ততক্ষণে অনেক ভোটার জড়ো হয়েছিলেন। ভোটের আগেই বিবিসি’র ক্যামেরায় ধরা পড়া ব্যালট ভর্তি বাক্সের ভিডিও সকালেই প্রকাশ করা হয়েছিল। পরে অবশ্য ঐ কেন্দ্রটির ভোট স্থগিত করা হয়েছিল বলে জানানো হয়।
সকালেই ঢাকা এবং আশেপাশের এলাকায় সাংবাদিকরা অনেক অনিয়ম, কারচুপির ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
ভোট কেন্দ্র
ঢাকার কেন্দ্রগুলোতে বাইরে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল সকাল থেকেই। অনেক কেন্দ্রের বাইরের পরিবেশ দেখে ভিতরের অবস্থা বোঝার উপায় ছিল না।
ভোট শুরুর ঘন্টাখানেক পর থেকেই অনেক কেন্দ্রের ভিতরে আওয়ামী লীগ বা তাদের জোটের প্রার্থীর সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দেখা যায়।
ঢাকার বিভিন্ন আসনে অনেক কেন্দ্রে বিএনপিসহ বিরোধী জোটের প্রার্থীদের এজেন্ট ছিল না। কেন্দ্রগুলোর বাইরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
অনেক কেন্দ্রে সাংবাদিকরা দেখেছিলেন, পুলিশ সদস্যরা কেন্দ্রের মুল দরজা বন্ধ করে কাউকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। আর কেন্দ্রের ভিতরে সরকার সমর্থক প্রার্থীর পক্ষে ব্যালট পেপারে সিল মারা হচ্ছে; এমন অভিযোগ ছিল দিনভর।
দিন যত গড়াচ্ছিল, রাজধানীর কেন্দ্রগুলোর বাইরে শুধু ক্ষমতাসীনদের প্রার্থীর সমর্থকদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। অনেক কেন্দ্রে সাধারণ ভোটারেরাও দীর্ঘ অপেক্ষা করে ভোট দিতে না পারায় অনেকে তাদের ক্ষোভ তুলে ধরেন কেন্দ্রে থাকা সাংবাদিকদের কাছে।
সংবাদমাধ্যমের খবর হয়, কয়েক ঘন্টা ভোট হওয়ার পরই কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ নিয়ে যখন নানান খবর বা অভিযোগ প্রকাশ হচ্ছিল, তখনই ঢাকার কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি আরও কমে গিয়েছিল।
ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ নিয়ে যে সব খবর পাওয়া গিয়েছিল, সেই খবরের ভিত্তিতে এটি একটি নিয়ন্ত্রিত এবং একচেটিয়া নির্বাচন ছিল বলা যায়।
ঢাকার শেওড়াপাড়ার একটি ভোটকেন্দ্রের সামনে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। তবে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও অনেকে কেন্দ্রে ঢুকতে পারেননি। দেশের অন্য এলাকাগুলো থেকেও ভোট নিয়ে একই রকম অভিযোগ আসে।
ভোটের পুরোটা সময় ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র নিয়ে শুধুই অনিয়ম কারচুপির নানা অভিযোগ পাওয়া যায়।
ভোটের দিন সহিংসতাও ঘটে। চট্টগ্রামের পটিয়াসহ দেশের কয়েকটি জায়গায় নির্বাচনী সহিংসতা বা সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
নির্বাচন নিয়ে টিআইবি
বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ৫০টি আসনের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর এক পরিবীক্ষণের ফলাফলে ৪৭টিতেই অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল।
সংস্থার বাংলাদেশ শাখার নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, তাদের পর্যবেক্ষণের এবং বিশ্লেষণের পেছনে যথাযথ তথ্যপ্রমাণ তাদের কাছে রয়েছে।
নির্বাচন আচরণবিধির ব্যাপক লঙ্ঘনে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং একধরনের অভূতপূর্ব নির্বাচন হয়েছে যার ফলে এই নির্বাচন অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য হিসাবে আলোচিত হচ্ছে।
জানা যায়, নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিবীক্ষনের জন্য র্যানডম স্যাম্পলিং বা দৈব-চয়নের ভিত্তিতে এই ৫০টি আসন নির্ধারিত করে টিআইবি। শিডিউল ঘোষণার পরপরই সংস্থার কর্মীরা তাদের কাজ শুরু করেছিলেন।
বড় কী কী অনিয়ম হয়েছে এই প্রশ্নে ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল দেওয়ার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। প্রতিপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়নি। অনেক ভোটার ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারেননি।
বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারার দৃষ্টান্ত রয়েছে। জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে। ভোট শুরুর আগে ব্যালট ভর্তি বাক্স দেখা যায়। ভোট শেষের আগে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যায়। গণমাধ্যমের জন্য ‘অভূতপূর্ব’ কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল।
নির্বাচন কমিশন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসন প্রতিপক্ষকে দমন করার ব্যাপারে সরকারের সাথে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সম্পর্কে ড. জামান বলেন, নির্বাচন কমিশন যে যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। পুলিশ ও প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে নির্বিকার ছিল, অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাও এই লঙ্ঘনের অংশীদার ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রমাণ কী রয়েছে তাদের কাছে এই প্রশ্নে ড. জামান বলেন, অভিযোগগুলো ব্যাপক এবং এসব অভিযোগের যথার্থতা এবং গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়েছে… আমাদের প্রতিটি পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ সম্পর্কে যথাযথ তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।
অন্যান্য দলগুলোর প্রতিক্রিয়া
বাম জোট আজকের দিনটিকে ‘কালো দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে, যারা আগের দুই বছরেও একই ধরনের কর্মসূচি পালন করেছে। তাদের বক্তব্য ছিল, ‘২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ক্ষমতাসীন দল পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে দিনের ভোট রাতে করার মধ্য দিয়ে অবৈধভাবে পুনঃক্ষমতাসীন হয়েছে।’
একই অভিযোগ করে বিএনপি গত বছর দিনটি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করলেও এবার সে রকম কোনো কর্মসূচির কথা শোনা যায়নি। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেওয়ার দাবিতে তারা অবশ্য অন্য কিছু কর্মসূচি পালন করছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে জানা যায়, পিপলস অ্যাকশন কমিটি নামের একটি অরাজনৈতিক সংগঠন তাদের ভাষায় ‘ভোটের তৃতীয় শাহাদাতবার্ষিকী’ উপলক্ষে বুধবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২৫
আপনার মতামত জানানঃ