প্রায় দুই বছর করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে অনেকটা সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এই ভাইরাসে ইতিমধ্যে ২৮ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেলেও গত তিন মাস ধরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকার দাবি দেশের স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টদের। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগ সফলতার কথা বললেও ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর চেয়ে এখনো আমরা অনেক পিছিয়ে। মহামারি মোকাবিলায় যথাযথ প্রস্তুতির কথা বললেও ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবিলায় এখনও অপ্রস্তুত বাংলাদেশ। সম্প্রতি গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি ইনডেক্সে (জিএইচএক্স) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এর প্রমাণও মিলছে।
প্রতিবেদনটি যৌথভাবে প্রকাশ করেছে নিউক্লিয়ার থ্রেট ইনিশিয়েটিভ এবং ব্লুমবার্গ স্কুল অফ পাবলিক হেলথের জনস হপকিন্স সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটি।
করোনা মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের নাজুক পরিস্থিতি দেখে ভবিষ্যতে অন্য মহামারি মোকাবিলায় দেশগুলোর প্রস্তুতি কেমন সেটি দেখতেই এই গবেষণা করা হয়।
গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি ইনডেক্সের (জিএইচএক্স) বিচারে মহামারি মোকাবিলার সক্ষমতার বিচারে ১৯৫টির মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা ৯৫তম।
গত বছর ১৯৫টি দেশের মধ্যে ১১৫তম ছিল বাংলাদেশ। সক্ষমতার দিক থেকে কিছুটা হলেও অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। তবে সামগ্রিক বিচারে এখনও অপ্রস্তুত।
এমন অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মহামারি প্রস্তুতি দিবস’। বিশ্বব্যাপী মহামারি প্রতিরোধে সতর্কতা, প্রস্তুতি ও অংশীদারিত্বের গুরুত্ব তুলে ধরতে গত বছর ২৭ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক মহামারি প্রস্তুতি দিবস ঘোষণা করে জাতিসংঘ।
গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, মহামারি দেখা দেওয়া মাত্র তা প্রতিরোধে সক্ষম এমন ১০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ। যা একশটি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে দ্রুত রোগ শনাক্ত ও নমুনা পরীক্ষায় ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গেল দুই বছরে করোনা নিয়ন্ত্রণে আনতে টিকাদান কর্মসূচি, করোনা শনাক্তে পরীক্ষাগার বৃদ্ধি, জরুরি সেবা নিশ্চিত, হাসপাতালে শয্যা ও সেবার মান বৃদ্ধিতে সফলতা দেখা দিয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশে প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে। এখনো সব জায়গাতে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। করোনা নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখা দিলেও অন্য মহামারির বিপর্যয় রুখে দেওয়ার মতো দক্ষ জনবল সংকট রয়েছে। যথাযথ অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ফলে মহামারি নয়, ছোটখাটো রোগের প্রকোপ দেখা দিলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই ভবিষ্যৎ মহামারিতে সার্বিক প্রস্তুতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে।
তারা বলেন, দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে এলেও এখনো আমরা মহামারির মধ্যেই আছি। পরবর্তী যে কোনো মহামারি প্রতিরোধে আগাম প্রস্তুতি নিতে হলে দুটি বিষয় এখন থেকে গুরুত্ব দিতে হবে। একটি হচ্ছে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত। অন্যদিকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এই দুটি বিষয় এখন থেকে নজর দিতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব এটি উন্নতি করা দরকার। এখন সব মানুষ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসেনি। তাদের এই সেবার আওতায় আনতে হবে। তাহলে ভবিষ্যৎ মহামারি আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশে প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে। এখনো সব জায়গাতে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। করোনা নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখা দিলেও অন্য মহামারির বিপর্যয় রুখে দেওয়ার মতো দক্ষ জনবল সংকট রয়েছে। যথাযথ অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ফলে মহামারি নয়, ছোটখাটো রোগের প্রকোপ দেখা দিলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
আরও বলেন, দ্রুত রোগ শনাক্তের ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে। স্বাস্থ্য শিক্ষায়ও গুরুত্ব দিতে হবে। রোগ হওয়ার আগে যদি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে সেটার দিকে এখনই নজর দিতে হবে।
এদিকে ভবিষ্যতের মহামারিগুলোর ভয়াবহতা বর্তমানের কোভিড পরিস্থিতিকে ছাপিয়ে যেতে পারে, করোনা ভাইরাসের সংকটের চেয়ে ভবিষ্যতের মহামারি আরো মারাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সারাহ গিলবার্ট।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার অন্যতম এই উদ্ভাবক সতর্ক করে বলেছেন, বর্তমান করোনা সংকটের চেয়ে ভবিষ্যতের মহামারি আরও প্রাণঘাতী হতে পারে।
সতর্ক করে দিয়ে সারাহ গিলবার্ট বলেন, বর্তমান করোনা সংকটের চেয়ে ভবিষ্যতের মহামারি আরও মারাত্মক হতে পারে। ইতিমধ্যে যে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে তা যাতে বৃথা না যায়, সেজন্য মহামারি মোকাবিলার প্রস্তুতিতে আরও তহবিল দরকার।
করোনার ধরন সম্পর্কে আরও তথ্য না জানা পর্যন্ত লোকজনের ওমিক্রনের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলে মন্তব্য করে সারাহ গিলবার্ট বলেন, কোনো ভাইরাস দ্বারা মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়ার এটাই শেষ ঘটনা হবে না। সত্য হলো, পরের মহামারিটি আরও খারাপ হতে পারে। সেটি আরও সংক্রামক বা আরও প্রাণঘাতী বা উভয়ই হতে পারে।
এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস সতর্ক করে বলেছেন, করোনা মহামারিই শেষ মহামারি নয়; আরও বড় মহামারি আসতে পারে। এ জন্য বিশ্বকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
তিনি বলেন, ‘এটাই শেষ মহামারি নয়; বিশ্বকে পরবর্তী মহামারির জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুত হতে হবে।’
গেব্রেয়াসুস বলেন, ‘ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়, মহামারি ও প্রাদুর্ভাব জীবনের একটা অংশ। তবে যখন পরবর্তী মহামারি আসবে, তখন বিশ্বকে প্রস্তুত থাকতে হবে। অন্তত এখনকার সময়ের চেয়ে আরও বেশি প্রস্তুত হয়ে থাকতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোভিড-১৯ মহামারি আন্তর্জাতিক কমিউনিটির সামনে সবচেয়ে বড় যে কাজগুলো করার সুযোগ তৈরি করেছে তার মধ্যে রয়েছে ভ্যাকসিনের প্রতি বৈশ্বিক আস্থা ফিরিয়ে আনা, তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য ও কল্যাণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা, জলবায়ু পরিবর্তন সামাল দেওয়া এবং ডিজিটাল বিভাজন দূর করা।
টিকা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, টিকা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থতা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে। এমনকি টিকা সংগ্রহ, পরিবহন ও বিশ্বব্যাপী সরবরাহে সহায়তার জন্য সরকার, অংশীদার ও দাতাদের সঙ্গে জনসাধারণ যাতে এটা গ্রহণ করে সে জন্য টিকার ওপর আমাদের অবশ্যই আস্থা বাড়াতে হবে। তারা বলেন, আস্থা ব্যতীত, টিকাগুলো কেবল চিকিৎসকের আলমারিতে থাকা দামি ওষুধের শিশি।
মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে বলেন, কোভিড-১৯ শিশু ও তরুণদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত ব্যাধিগুলো উদ্বেগজনক হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে আরও বেশি কাজ করতে আন্তর্জাতিক কমিউনিটির প্রতি তারা আহ্বান জানিয়েছেন।
তারা বলছেন, দেশগুলোকে এই সমস্যা মোকাবিলায় যত বিনিয়োগ দরকার তা করতে হবে, নাটকীয়ভাবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং কমিউনিটি ও স্কুলগুলোতে তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তার বিস্তার ঘটাতে হবে এবং ঝুঁকির মুখে থাকা পরিবারের শিশুরা যাতে বাড়িতে তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সুরক্ষা পায় তা নিশ্চিত করার জন্য শিশু লালনপালন সংক্রান্ত কর্মসূচি (প্যারেন্টিং প্রোগ্রাম) চালু করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪৬
আপনার মতামত জানানঃ