টিকা নিলে করোনার ভয়াবহতা কমবে, এমনই বলছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু টিকা যে করোনাকে পুরোপুরি আটকাতে পারবে; সে সম্ভাবনার কথা কেউ বলছেন না। এমনকি টিকা নেওয়ার পরেও অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। মানুষ টিকা নেয়া শুরু করলে, আস্তে আস্তে করোনার সংক্রমণ কমতে শুরু করবে; এই ধারণা মূলত ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার পর সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সুরক্ষা পাওয়া যায়। শরীরে কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এর এক-দুই মাস পর বুস্টার ডোজ নেওয়ার দিন দশেকের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি পূর্ণ সুরক্ষা পাওয়া যায়। তাহলে কেন টিকা গ্রহণের পরও কারও কারও করোনা হচ্ছে?
একটি নয়, দু’টি টিকা নেওয়ার পরেও অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন করোনায়। এর কারণ কী? তবে কি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ টিকা দিয়ে আটকানো যাবে না?
টিকা নিয়ে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ
বিজ্ঞানী মহলে এমন নানা রকম সন্দেহ ছিল। এবার সেই সন্দেহের কিছুটা অবসান হল। আমেরিকার ওহাইও ইউনিভার্সিটির গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন, কেন টিকা নেওয়ার পরেও করোনার সংক্রমণ হচ্ছে।
সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণাপত্রে কোভিড সংক্রমণের ধরন নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, অন্য যে কোনও ভাইরাসের সংক্রমণের ধরন আর কোভিড-১৯ এর ধরন এক নয়।
একটি কোষ থেকে আরেকটি কোষে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত কোষটি থেকে নতুন কোষে যাওয়ার সময় ভাইরাসের পথে রুখে দাঁড়ায় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হলে সহজেই ভাইরাস এক কোষ থেকে আরেক কোষে ছড়িয়ে পড়ে। সংক্রমণ বাড়তে থাকে।
অন্য ভাইরাসের সংক্রমণ আটকানোর ক্ষেত্রে টিকা কাজে লাগে, কারণ সেটি ওই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাটিকে বাড়িয়ে দেয়। চেনা জীবাণু সামনে এলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তাকে আটকায় সহজেই।
আর কোভিডের ক্ষেত্রে এটিই হচ্ছে না। কারণ কোষের ভিতরে এটি লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের ধরন বদলাচ্ছে। ফলে এক কোষ থেকে অন্য কোষে যাওয়ার সময়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তাকে চিনতেই পারছে না।
ভাবছে, এটি অন্য কোনও জীবাণু। ফলে আরাম করেই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে পরের কোষটিতে।
ভাইরাসের সংখ্যাও গুরুত্বপূর্ণ। টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা খুব অল্প সংখ্যক ভাইরাসের সংস্পর্শে এলে বেশিরভাগ সময়ই আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার টিকা নেওয়া ব্যক্তি বেশি সংখ্যক ডেল্টা ধরনের সংস্পর্শে এলে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।
কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিক সংক্রমণের হার বেড়ে গেলে সমস্যা আরও তীব্র হবে। কারণ ভাইরাস তখন সংখ্যায় ও শক্তিতে আরও বাড়বে।
একজন টিকা নেওয়া ব্যক্তি করোনায় সংক্রমিত হতে পারেন কিনা- তা নির্ভর করে টিকা নেওয়ার পর তার শরীরে কত দ্রুত অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, সে অ্যান্টিবডি করোনার বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর এবং টিকা নেওয়ার পর ওই ব্যক্তির রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমাণ কমে গেছে কি না— এসবের ওপর।
ওহাইওর বিজ্ঞানীদের এই নতুন আবিষ্কার টিকাকে আরও উন্নত করার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে বলে মনে করছেন অনেকে। এখন না হলেও হয়তো আগামী দিনে শীঘ্রই আটকানো যাবে করোনাভাইরাসকে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ‘ব্রেকথ্রু ইনফেকশনে’র (টিকা নেওয়ার পরও করোনায় আক্রান্ত হওয়া) সংখ্যা এখনও তুলনামূলকভাবে একেবারেই কম। আর টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত হলেও তাদের খুব কম সংখ্যকই গুরুতর অসুস্থ হন।
‘ব্রেকথ্রু ইনফেকশনে’ মৃত্যুর ঘটনা এবং হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও একেবারেই নগণ্য। করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মানুষগুলোর ৯৭ শতাংশই টিকা নেননি।
‘ব্রেকথ্রু ইনফেকশন’ হওয়ার মানে এই নয় যে, টিকা অকার্যকর। তবু টিকা নেওয়া ব্যক্তিরাও সংক্রমিত হতে পারেন। তাদের ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না, কিংবা খুব হালকা উপসর্গ দেখা দেয়। এর ফলে টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা নিজেদের অজান্তেই অন্যদের মাঝে ভাইরাস ছড়াতে পারেন।
জাতীয় পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রথমে দেখতে হবে উনি দুই ডোজ টিকা কোন কোম্পানির নিয়েছেন। টিকা নেয়ার পর অনেক বিষয় রয়েছে। যেমন টিকা নেয়ার পর তার শরীরে কি পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তা জানা হয়েছে কিনা। টিকা কার্যকর হলো কিনা।
তিনি বলেন, যিনি মারা গেছেন তার শরীরে হয়তো অ্যান্টিবডি গ্রো হয়নি। এ ছাড়াও তিনি আগে থেকে কোনো জটিল রোগে ভুগছিলেন কিনা। এগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা প্রয়োজন। এজন্য ভালো পরিকল্পনা দরকার।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং সংস্থাটির উপদেষ্টা ডা. মুস্তাক হোসেন এ বিষয়ে বলেন, দুই ডোজ টিকা নেয়ার পর মৃত্যুর বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগের তদন্ত করে বের করা উচিত। কি কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। টিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা। যিনি মারা গেছেন তার শরীরে আগ থেকে কোনো জটিল রোগ ছিল কিনা।
তিনি আরও জানান, টিকা নেয়ার পর প্রতি ১০ লাখে ১ জন মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ ছাড়া অন্যদেশের এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে মিল আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখতে হবে বলে এই জনস্বাস্থ্যবিদ মনে করেন।
বেইলর কলেজ অফ মেডিসিনের জিনেটিসিস্ট ক্রিস্টেন প্যান্থাগানি বলেছেন, টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের সংক্রমিত হওয়া ঠেকাতে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে, টিকার কাজ মানুষকে গুরুতর অসুস্থ হওয়া থেকে রক্ষা করা। সেই কাজ টিকা খুব ভালোভাবেই করছে।
তিনি বলেন, কোনো টিকাই একশোভাগ কার্যকর নয়—এটা কখনও সম্ভবও নয়। কোভিড টিকা নিখুঁত হবে—এমন আশা করাও উচিত নয় আমাদের।
গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু ঠেকানোর জন্য করোনার টিকা কার্যকর। কিন্তু ভয়ংকর এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে অভেদ্য নিরাপত্তাব্যূহ হিসেবে দাঁড়ানোর সামর্থ্য এখনও অর্জন করেনি এসব টিকা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩১০
আপনার মতামত জানানঃ