বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনার ওমিক্রন ধরনের উদ্বেগজনক প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করতে গতকাল মঙ্গলবার একাধিক টুইট করেছেন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। আজ বুধবার প্রথম আলোর অনলাইনের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
বিল গেটস তার টুইটে জানিয়েছেন, ওমিক্রন বিস্তারের প্রেক্ষাপটে তিনি তার বেশির ভাগ ছুটির পরিকল্পনা বাতিল করেছেন।
বিশ্বের অন্যতম এই শীর্ষ ধনী উল্লেখ করেছেন, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ক্রমবর্ধমানভাবে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছেন।
এ অবস্থায় বিল গেটস তার অনুসারীদের এ সত্য উপলব্ধি করার আহ্বান জানিয়েছেন, ‘আমরা মহামারির সবচেয়ে খারাপ অংশে প্রবেশ করতে পারি।’
বিল গেটস তার টুইটে করোনার ওমিক্রন ধরনের বিপদ সম্পর্কে গুরুত্বের সঙ্গে সতর্ক করেন। বিশেষ করে ধরনটির পুনঃসংক্রমণের হারের ব্যাপারে সতর্ক করেন তিনি।
একই সঙ্গে বিল গেটস উল্লেখ করেন, করোনার ওমিক্রন ধরনটি সম্পর্কে মানুষের সামান্যই জানাশোনা রয়েছে।
বিল গেটস বলেন, ইতিহাসের যেকোনো ভাইরাসের চেয়ে ওমিক্রন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এটি শিগগির বিশ্বের প্রতিটি দেশে ছড়াবে।
মাইক্রোসফটের এই সহপ্রতিষ্ঠাতা আরও বলেন, ওমিক্রন মানুষকে কতটা অসুস্থ করে তোলে, সেটা এখনও অজানা বিষয়। যদি ওমিক্রনের কারণে অসুস্থতার মাত্রা ডেলটার অর্ধেক পরিমাণও গুরুতর হয়, তবে তা হবে এখন পর্যন্ত দেখা করোনার সবচেয়ে খারাপ ঢেউ। কারণ, ওমিক্রন খুবই সংক্রামক।
বিল গেটসের কাছ থেকে এমন এক সময় এই সতর্কবার্তা এল, যখন যুক্তরাষ্ট্রে ওমিক্রন আধিপত্যশীল ধরন হয়ে উঠেছে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশটিতে ওমিক্রনের সংক্রমণ ৩ থেকে বেড়ে ৭৩ শতাংশ হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) জানিয়েছে, শেষ হওয়া সপ্তাহে দেশটিতে নতুন শনাক্ত করোনা রোগীদের মধ্যে ৭৩ দশমিক ২ শতাংশই ওমিক্রন ধরনে সংক্রমিত।
বর্তমান সময়ে করোনা-সংক্রান্ত সতর্কতা অনুসরণ করা কতটা জরুরি, তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন বিল গেটস। মাস্ক পরা, বাইরে বড় জমায়েত এড়িয়ে যাওয়া ও টিকা নেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি।
বিল গেটস একটি ইতিবাচক মন্তব্য দিয়ে তার সচেতনতামূলক টুইট শেষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘একদিন মহামারি শেষ হবে। আমরা যত ভালোভাবে একে অপরের প্রতি যত্নশীল হব, তত তাড়াতাড়ি সেই সময় আসবে।’
কতটা ভয়াবহ ওমিক্রন?
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মানবদেহে সংক্রমণের পর অসংখ্যবার রূপ বদল করলেও এক বছরের বেশি সময় পর ভারতীয় ‘ডেলটা’ ধরনই বিশ্বব্যাপী মহামারির মাত্রা ভয়াবহ করে তোলে। এরপর মহামারি নিয়ন্ত্রণে টিকা যখন আশার আলো দেখাচ্ছে, তখনই আফ্রিকায় শনাক্ত হয় করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন।
গত ২৪ নভেম্বর আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানায় এ ধরনটি প্রথম শনাক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে সংক্রমণের তালিকায় প্রতিদিনই একের পর এক দেশের নাম যুক্ত হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত বিশ্বের ৯০ দেশে ওমিক্রনের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।
আফ্রিকার সাতটি এবং ইউরোপের দুটি দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন (সামাজিক সংক্রমণ) শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৩ থেকে ৭৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে ওমিক্রনে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা।
ওমিক্রন নিয়ে বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের ঢেউ বইতে শুরু করেছে। ইউরোপের অনেক দেশ লকডাউনে চলে গেছে। কয়েকটি দেশের যাত্রীদের ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
বাংলাদেশও আফ্রিকার সাতটি দেশ থেকে আসা যাত্রীদের ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন করার নির্দেশনা দিয়েছে। এই সময়ে তাদের দু’বার নমুনা পরীক্ষা করাতে হবে। জাপান আফ্রিকা থেকে ভ্রমণে আসা ব্যক্তিদের ১০ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। এই সময়ে তাদের চারবার নমুনা পরীক্ষা করাতে হবে।
জার্মানি ঘোষণা দিয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা নিজ দেশের নাগরিকদেরই কেবল প্রবেশের অনুমোদন দেবে তারা। ভারতও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যাত্রীদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে বড়দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন না করার আহ্বান জানিয়েছে। এতে সাড়া দিয়ে অনেক দেশ বড়দিনের অনুষ্ঠানে না করা এবং কিছু দেশ সীমিত পরিসরে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে থার্টি ফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠানের বিষয়েও অনেক দেশ বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষকরা ওমিক্রনের লক্ষণ আছে এমন ১১ হাজার ৩২৯ জনের সঙ্গে অন্যান্য ধরনে সংক্রমিত প্রায় দুই লাখ মানুষের তুলনা করেন।
এতে দেখা যায়, লক্ষণের কথা জানানো ব্যক্তিদের পরীক্ষা করে যতজনকে পজিটিভ পাওয়া গেছে, তার অনুপাত বিবেচনায় অথবা সংক্রমিত হওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর অনুপাত বিবেচনায় ওমিক্রন ডেলটার চেয়ে কম গুরুতর এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষেধক টিকার দুই ডোজ গ্রহণের পর ওমিক্রন লক্ষণযুক্ত সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা শূন্য থেকে ২০ শতাংশ। আর বুস্টার ডোজের পর তা ৫৫ থেকে ৮০ শতাংশ হয়। এ ছাড়া ডেলটায় সংক্রমিত হওয়ার চেয়ে ওমিক্রনে সংক্রমিক হওয়ার আশঙ্কা ৫ দশমিক ৪ গুন বেশি।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি
বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই দুইজন শনাক্ত হয়েছেন। তারা দুজনই জিম্বাবুয়েফেরত জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সদস্য। আক্রান্ত দুই নারী ক্রিকেটার সুস্থ আছেন।
ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ লকডাউন দিয়েছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশও এই ব্যবস্থায় যাবে কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ইউরোপের অনেক দেশ লকডাউন দিয়েছে। আমরা আমাদের দেশে লকডাউন চাচ্ছি না।
সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে জাহিদ মালেক বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। দেশে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন নেই, কিন্তু করোনা তো (অন্য ভ্যারিয়েন্ট) আছে! ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকেও যদি আমরা রক্ষা পেতে চাই, আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে- যেটি আমরা করছি না।
মাস্ক না পরলে এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানলে দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘ওমিক্রন’ বিশ্বের ৯০ দেশে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের দেশেও ধরা পড়েছে। কিন্তু মানুষ মাস্ক পরছে না এবং স্বাস্থ্যবিধিও মানছে না। এ জন্য ওমিক্রন বাড়ার আশঙ্কা করছে সরকার।
এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের সমালোচনা করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষ যেন বেপরোয়াভাবে না ঘুরে বেড়ায়; কিন্তু সেটা হচ্ছে, রাজনৈতিক অনুষ্ঠানগুলো কীভাবে হয়? কক্সবাজারে লাখ লাখ মানুষ যাচ্ছে, কেউ মাস্ক পরছে না। বিয়ে হচ্ছে, কেউ মাস্ক পরছে না। তাহলে সংক্রমণ বাড়ার সুযোগ তো রয়েছে! আমরা এ বিষয়ে দুঃখিত।’
জাহিদ মালেক বলেন, সারা দেশের মানুষ যাতে আগের মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, এ জন্য জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনদের চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ কোভিড নিয়ন্ত্রণে সফলতার উদাহরণ হয়েছে। সব হাসপাতালে এখন অক্সিজেন সাপোর্ট আছে। সংক্রমণ কমে গেছে। এটি ধরে রাখতে হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে টিকা কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে সাত কোটি, যা ৬০ শতাংশ মানুষ পেয়েছে। আর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে সাড়ে চার কোটি, শতকরা হিসাবে তা ৩০ ভাগ।
তিনি বলেন, সরকারের টার্গেট ১২ থেকে ১৩ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া। এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ৩০ শতাংশ মানুষকে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩০
আপনার মতামত জানানঃ