সংঘর্ষ, কারচুপি ও ব্যাপক সন্ত্রাসের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছে কলকাতা পৌর করপোরেশনের ১৪৪টি ওয়ার্ডের নির্বাচন। যার ফলাফল আজ মঙ্গলবার ঘোষিত হচ্ছে। এতে এগিয়ে আছে তৃণমূল কংগ্রেস। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী এই ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল জিততে চলেছে ১৩৩টি ওয়ার্ডে। বিজেপি ৩টি ওয়ার্ডে আর বাম দল ও কংগ্রেস যথাক্রমে ৪টি ও ২টি ওয়ার্ডে জিতছে। আরও জিতছে ২ জন নির্দলীয় প্রার্থী।
বুথফেরত সমীক্ষায় রোববার বলা হয়েছিল, বিপুল ভোটে জিতবে তৃণমূল। সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছিল, তৃণমূল পেতে পারে ৫৮ শতাংশ ভোট। বিজেপি ২৮, বামফ্রন্ট ৫, কংগ্রেস ৭ এবং অন্যরা ২ শতাংশ ভোট পেতে পারে। আর ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল পেতে পারে ১৩১, বিজেপি ১৩ এবং বাম দল, কংগ্রেস অন্যরা শূন্য আসন পেতে পারে।
ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী বাম দল ও কংগ্রেসকে শূন্য করতে পারেনি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে নির্বাচনে তৃণমূল ১১৪, বিজেপি ৭, বামফ্রন্ট ১৫, কংগ্রেস ৫টি আসন এবং অন্যরা ৩টি আসনে জিতেছিল।
ফলে তৃণমূল নেতারা বারবার নির্বাচনী প্রচারে করপোরেশনকে বিরোধী শূন্য করার ঘোষণা দিলেও ফলাফলে বরং বাম দল ৪টি ও কংগ্রেস ২টি আসন ছিনিয়ে নিয়েছে। এমনকি নির্দলীয় প্রার্থীরাও ২টি আসন পেয়েছে। ফলে তৃণমূলে পৌর করপোরেশনকে বিরোধী শূন্য করার ঘোষণা দিলেও কার্যত তা হয়নি।
ভোটের আগে তৃণমূল থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, এবারের পৌর ভোটে কোনো অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। শুধু তা–ই নয়, ভোটে কেউ কারচুপি ও সন্ত্রাস করলে, অশান্তি করলে তৃণমূল তাদের দল থেকে তাড়িয়ে দেবে।
তবে পৌরসভা নির্বাচনের দিন অশান্তি হয়েছে। বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এজেন্টদের হেনস্থা করার অভিযোগ করছে কংগ্রেস, বাম ও বিজেপি। বহু জায়গায় বিরোধী এজেন্ট ছিল না। সিসিটিভি ক্যামেরার মুখ উপর বা নীচের দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার অভিযোগও উঠেছে। সব মিলিয়ে এই পৌর ভোট নিয়েও অনিয়মের প্রচুর অভিযোগ আছে। বড়বাজারে বুথদখল করে অশান্তির ছবি টিভি ক্যামেরাতেও ধরা পড়েছে। কয়েকটি জায়গায় বোমবাজিও হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের বিরোধীদলীয় নেতা ও বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী এই পৌর ভোট বাতিলের দাবি করে নতুন করে ভোট গ্রহণের দাবি তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ন্যূনতম গণতন্ত্র নেই এ বাংলায়। পৌর ভোটের নামে কলকাতায় চলেছে প্রহসন। শুভেন্দুর দাবি, ভোট হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ। আর ৮০ শতাংশ হয়েছে চুরি। যদিও শাসক দল এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ভোটে সহিংসতা ও বাধা দেওয়ার যেসব অভিযোগ বিরোধীরা এনেছেন নির্বাচন কমিশন তা মানতে নারাজ। কমিশনের দাবি, কোথাও ভোটে বাধা দেওয়া হয়নি, ভোট বন্ধও হয়নি।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী এই ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল জিততে চলেছে ১৩৩টি ওয়ার্ডে। বিজেপি ৩টি ওয়ার্ডে আর বাম দল ও কংগ্রেস যথাক্রমে ৪টি ও ২টি ওয়ার্ডে জিতছে। আরও জিতছে ২ জন নির্দলীয় প্রার্থী।
ভোটের ফল পেয়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে এক টুইটে পশ্চিম বঙ্গ মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল সভাপতি মমতা ব্যানার্জি বলেন, পৌর নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের আমি উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাই। অধ্যবসায় ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মানুষের সেবা করার বিষয়টি মনে রাখবেন।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে ভোট দিয়ে যারা আমাদের উপর বিশ্বাস রেখেছেন তাদের সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাই।
সাধারণত কোন নির্বাচনের আগেই নামি-দামী ব্যক্তিদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোতে যোগ দিতে দেখা যায়, কিংবা এক দল ছেড়ে আরেক দলে যোগ দেওয়ার প্রবণতা চোখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক প্রতিটি নির্বাচনেও এ চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে গত মার্চ-এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত বিধানসভার নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রায় প্রতিদিনই পালা করে রাজ্যটির ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক-কাউন্সিলর-পঞ্চায়েত প্রধান থেকে শুরু করে দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকরাও দলে দলে বিজেপিতে যোগ দিতে দেখা গেছে। দলবদলের হিড়িক দেখে অনেকেই মুচকি হেসে কটাক্ষ করেছিলেন যে তৃণমূল দল আদৌ থাকবে কি না!
গত ২ মে ভোটের ফল বের হয়, তাতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয়বারের মতো রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। এরপর সরকারও গড়ে তারা। কিন্তু ভোটপর্ব মিটলেও ফের দলবদলের হিড়িক! তবে এবার ছবিটা উল্টো! বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগদানের হিড়িক পড়েছে কলকাতা থেকে জেলায় জেলায়।
সর্ব ভারতে ক্রমশ শক্তি বৃদ্ধি করে চলছে তৃণমূল। কংগ্রেসের অন্দরে ফাটল ধরিয়ে ত্রিপুরা, আসাম, গোয়া, হরিয়ানার পর মেঘালয় থেকে বিধায়করা কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছে।
শুধু কংগ্রেস নয়, অনেক আগেই বিজেপির প্রবীণ নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী যশবন্ত সিনহাও তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। সম্প্রতি বিজেপি নেতা সুধীন্দ্র কুলকার্নি ও জেডিইউ নেতা পবন বর্মা যোগ দেন তৃণমূলে।
গুঞ্জন রয়েছে,তৃণমূলে যোগ দিতে আরও একাধিক কংগ্রেস ও বিজেপি’র শীর্ষনেতা পাইপলাইনে রয়েছেন। দেশের দু’টি সর্ব বৃহৎ দল ভেঙে নেতাদের তৃণমূলে চলে যাওয়া অবশ্য অস্বস্তিতে ফেলছে কংগ্রেস-বিজেপিকে।
কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের সখ্যের পুঁজিকে বিরোধিতা করেই বাংলায় নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করে চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়েছিলেন মমতা। সেই অবস্থান ধরে রেখেই বাংলায় কংগ্রেসকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে তৃণমূল। ঠিক একইভাবে কেন্দ্রে মোদি সরকারকে উৎখাত করতে কংগ্রেস কতটা আন্তরিক সেই প্রশ্নকে সামনে রেখেই দেশের বিরোধী রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করছেন মমতা।
সম্প্রতি জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে তৃণমূল রাজ্যে রাজ্যে যে অবস্থান নিচ্ছে, তাতে স্পষ্ট হচ্ছে যে কংগ্রেসের বদলে তারাই প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠে আসতে চাইছে। একুশের বিধানসভা ভোটের পর থেকে একের পর এক কংগ্রেস নেতা তৃণমূলে যোগ দেওয়ার হিড়িক পড়েছে। সারা দেশে কংগ্রেসের সমান্তরাল ভিত্তি গড়ে তোলার যে চেষ্টা চলছে, তা মমতার রণকৌশল এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
দলীয় সূত্র ঘরোয়াভাবে জানাচ্ছে, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলকে সঙ্গে নিয়ে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে জোট তৈরি করতে চাইছেন মমতা। সম্প্রতি মেঘালয়ের ঘটনার পর একথা আরও স্পষ্ট যে, এবার প্রকাশ্যেই বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের দুর্গে হানা দেবে তৃণমূল। সম্প্রতি লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা অধীর চৌধুরী বলেন, ‘কংগ্রেসকে ভাঙার চক্রান্ত শুধু মেঘালয়ে নয়, পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে চালাচ্ছে তৃণমূল।’
গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক শিবিরে যে তর্ক সামনে এসেছে, তা হল— কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিজেপি-বিরোধী জোটের ধারণা আসলে সোনার পাথরবাটি কি না। দেশে ১২০টিরও বেশি আসনে লড়াই সরাসরি কংগ্রেস বনাম বিজেপির। কোনও স্থানীয় দলের পায়ের ছাপ সেভাবে সেখানে নেই। এমনও নয় যে, পোড়খাওয়া নেত্রী মমতা জাতীয় রাজনীতির এই বাস্তবতা জানেন না। আর তাই কংগ্রেস শিবিরের তোপ, আসলে কংগ্রেসকে বাইরে রেখে জোট গড়ার নামে বিজেপির হাতই শক্ত করছে তৃণমূল।
তৃণমূলের অবশ্য যুক্তি অন্য। সূত্রের বক্তব্য, বিভিন্ন রাজ্যে দলীয় সংগঠন বাড়িয়ে নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে নিজের বিজেপি বিরোধী মুখকে আরও ঝকঝকে করতে চাইছেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে বড় ব্যবধানে হারিয়েছেন তারা। একদিকে তাই রাজ্যে-রাজ্যে কংগ্রেস থেকে নেতা-কর্মীদের তৃণমূলে যোগ দেওয়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।
মমতা স্পষ্ট জানিয়েছেন, ‘আমরা সব রাজ্যে লড়ব না। যেখানে যে আঞ্চলিক দল শক্তিশালী, আমরা তাদের পাশে থেকে সমর্থন দেব।’ যে কারণে উত্তরপ্রদেশে তৃণমূলের ইউনিট খোলার কথা জানিয়েও তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্য, এসপি নেতা অখিলেশ সিং যাদব যদি সাহায্য চান, তিনি সমর্থন করবেন।
রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, এক সময়ে প্রধানমন্ত্রিত্বের ‘স্বপ্ন দেখা’ পাওয়ারের রাষ্ট্রপতি হওয়ার অভিলাষ ক্ষমতার করিডরে গোপন বিষয় নয়। সে ক্ষেত্রে তাকে রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী হিসেবে সামনে রেখে জাতীয় রাজনীতিতে ঘুঁটি সাজাতে পারে তৃণমূল। মমতার উদ্যোগে যদি বিভিন্ন আঞ্চলিক বিরোধী দল এককাট্টা হয়ে পাওয়ারের নামে সম্মত হয়, তখন সোনিয়া-রাহুল তাতে আর কোনও বিরোধী বাদ সাধতে পারবেন না বলেই মনে করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২২
আপনার মতামত জানানঃ