বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন ও কাঙ্ক্ষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি অর্জনে খাদ্য নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কয়েকটি ধাপে একগুচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যার মধ্যে রয়েছে খাদ্যের লভ্যতা বৃদ্ধি, বিশেষ করে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্যের ভৌত ও অর্থনৈতিক প্রাপ্যতা নিশ্চিত এবং খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা হ্রাস করা।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর ৭ কোটি থেকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১৭ কোটিতে পৌঁছেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার, সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়ন সম্ভাবনার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও আমরা উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন অর্জনে সক্ষম হয়েছি। জনগণের মাথাপিছু আয় ক্রমাগত বৃদ্ধির পাশাপাশি মৌলিক মানব উন্নয়ন সূচকের মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও আমাদের সাফল্য অভূতপূর্ব। যদিও দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে এখনো আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। যেমন উচ্চমাত্রার দারিদ্র্য, বৈষম্য বৃদ্ধি ও অনমনীয় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা।
গত বৃহস্পতিবার (১৬ ডিসেম্বর) জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি প্রতিবেদন-২০২১’-এ জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের পাঁচ কোটি ২০ লাখ মানুষ মাঝারি ও তীব্র খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে আছে। সংখ্যাটি ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ বেড়েছে। এ সময় নতুন করে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১২ লাখ।
এফএওর প্রতিবেদনে ২০২১ সালের পরিস্থিতি উঠে আসেনি। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে এ বছর গম, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, মাংস, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। আগে থেকেই বেশ চড়া চালের দাম। ফলে মানুষের কষ্ট আরও বেড়েছে। সরকারের তুলনামূলক কম দামে চাল, আটা, ডাল, ভোজ্যতেল ও চিনি বিক্রির দোকানে মানুষের দীর্ঘ লাইনই এর প্রমাণ দেয়।
এফএওর প্রতিবেদনে ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা ও জনসংখ্যার হার উল্লেখ করা হয়। দেখা যায়, কয়েক বছর ধরে ঝুঁকি থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। জনসংখ্যার হার বিচারে ২০১৮ থেকে ২০২০ সময়ে খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে ছিল ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ, যা ২০১৭ থেকে ২০১৯ সময়ের তুলনায় কিছুটা বেশি।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক চিত্রও পাওয়া যায় এফএওর প্রতিবেদনে। এতে দেখা যায়, ঝুঁকিতে থাকা জনসংখ্যার হার বিবেচনায় বাংলাদেশ নেপালের চেয়ে এগিয়ে আছে। পিছিয়ে আছে মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোর চেয়ে। ভিয়েতনাম এ ক্ষেত্রে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। ওই দেশে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে আছে মাত্র সাড়ে ৬ শতাংশ মানুষ।
খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকির জন্য দায়ী করোনা
এফএও গত বৃহস্পতিবার এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি প্রতিবেদনের পাশাপাশি ‘বৈশ্বিক খাদ্য ও কৃষি পরিস্থিতি-২০২১’ প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। এতে প্রাক্কলন করা হয়, বিশ্বে ২০২০ সালে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭২ থেকে ৮১ কোটির মতো, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৬ কোটি বেশি।
খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে এই পরিবর্তনের কারণ হিসেবে এফএওর দুই প্রতিবেদনে মূলত করোনা পরিস্থিতিকে দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, করোনাকালে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে খাদ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বাণিজ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বিশেষ করে গ্রামীণ দরিদ্র ও দুর্গম এলাকার মানুষকে খাদ্য পেতে বেশি কষ্ট করতে হয়। খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বেশ কয়েকটি জরুরি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের পাঁচ কোটি ২০ লাখ মানুষ মাঝারি ও তীব্র খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে আছে। সংখ্যাটি ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ বেড়েছে। এ সময় নতুন করে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১২ লাখ।
বৈশ্বিক খাদ্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়, ৩৭ কোটি শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যে খাবার পেত, তা আর পাচ্ছে না। পরিবার থেকেও সমপরিমাণ খাবার না পাওয়ায় তাদের পুষ্টিহীনতা বেড়েছে।
স্বাস্থ্য খাতের চিত্র
এফএওর প্রতিবেদনে নারী, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্যের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি উন্নতির দিকে রয়েছে। প্রতিবেশীদের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।
একটি ক্ষেত্র হলো, পাঁচ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে খর্বকায় শিশুর হার। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে ৩৫ শতাংশ শিশু ছিল খর্বকায়। ২০২০ সালে তা ৩০ শতাংশে নামে। এদিক দিয়ে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে। তবে বাংলাদেশ শিশুর স্থূলতার (স্বাভাবিকের চেয়ে মোটা) দিক দিয়ে ভারত, মিয়ানমার ও নেপালের চেয়ে পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশের দুই দশমিক এক শতাংশ শিশু স্থূলকায়।
স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ওজন থাকা একধরনের পুষ্টিহীনতা। সাধারণত যেসব শিশু প্রয়োজনের চেয়ে কম পুষ্টিকর খাবার খায়, তারা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মোটা হয়ে যায় এবং নানা ধরনের রোগবালাইয়েও ভোগে। অর্থাৎ এরা ফল, মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম কম পায়; কিন্তু ভাত ও গমের মতো শর্করা বেশি খায়।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
খাদ্য মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে খাদ্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে দেশের জনগণ তাদের আয়ের বেশিরভাগ খাদ্যের জন্য ব্যয় করে। রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো সকল সময়ে সবার জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব সকল নাগরিকের খাদ্যের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা।
সরকারের কার্যবিধি অনুযায়ী জাতির জন্য একটি নির্ভরযোগ্য খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত। ১৯৯৬ সালের বিশ্ব খাদ্য শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত সংজ্ঞা অনুযায়ী সকল সময়ে সকল নাগরিকের কর্মক্ষম ও সুস্থ জীবন যাপনে প্রয়োজনীয় খাদ্য প্রাপ্তির ক্ষমতা নিশ্চিতকল্পে সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা কেবল খাদ্যের প্রাপ্যতা কিংবা আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে না, বরং পুষ্টি ধারণ করার জন্য পরিপূরক শর্ত যেমন নিরাপদ পানীয় জলের প্রাপ্যতা, স্যানিটেশন সুবিধা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মাতৃ ও সাধারণ শিক্ষার ওপর নির্ভর করে। সার্বিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য শরীরে পুষ্টির ভারসাম্য গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে শিশুদের জন্য। বাংলাদেশে খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি সত্ত্বেও অপুষ্টির উচ্চহার এখনো বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।
তারা বলছেন, অত্যধিক দারিদ্র্যের বিষয়টিও চিহ্নিত করা গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত, যেমন অত্যধিক দুর্বলতা ও অপুষ্টি, অসুখের প্রকোপ বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অক্ষমতা, যা প্রায়ই অকালমৃত্যুর কারণ হয়। পরিবারের খাদ্য অনিরাপত্তার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য। দরিদ্র পরিবারগুলোর খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার ক্ষমতা নেই। প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা থেকেও তারা বঞ্চিত। এমনকি দরিদ্র পরিবারগুলো যদিও কিছু পরিমাণ খাদ্য গ্রহণে সফল হয়, তবুও তাদের খাদ্য তালিকায় যে খাবারগুলো থাকে তা প্রয়োজনীয় গুণগতমানের চাহিদা ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পূরণে ব্যর্থ হয়। অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষেরা যেহেতু কম উৎপাদন শক্তিসম্পন্ন, তাই তারা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের একটি বিপজ্জনক চক্রের মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে। তারা প্রয়োজনীয় উপার্জন করতে সক্ষম হয় না, ফলে তারা প্রায়ই ক্রমাগতভাবে অসুস্থতা ও অক্ষমতা দ্বারা আক্রান্ত হয়। দরিদ্র পরিবারগুলোর শিশুদের জন্য এটি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। অপুষ্টি তাদের শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি করে, যার প্রভাবগুলো গুরুতর ও স্থায়ী। জীবনের প্রারম্ভে তারা যে অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয় বাকি জীবনে তারা কখনই এ পুষ্টির ঘাটতিজনিত সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা দারিদ্র্যের এ ভার বয়ে বেড়াতে বাধ্য হয়।
কেবল মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করাই খাদ্য নিরাপত্তা নয়। মানুষ যেসব প্রাণ-এর ওপর খাদ্যের জন্য নির্ভর করে, সেসব প্রাণের খাবার নিরাপদ করাও খাদ্য নিরাপত্তার অংশ বলে মন্তব্য করছেন প্রাণ ও প্রতিবেশ গবেষকরা। তারা বলছেন, মানুষের খাবার নিরাপদ করতে গিয়ে আমরা প্রকৃতির অন্য যেসব প্রাণ রয়েছে, তাদের অনিরাপদ করে তুলছি। মানুষের চেয়ে তাদের ‘ফুড ক্রাইসিসটা’ বেশি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩২
আপনার মতামত জানানঃ