পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে এক মামলার রায়ে হাইকোর্ট তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, মানুষের আশা-আকাঙ্খার সর্বশেষ জায়গা তথা আশ্রয়স্থল হলো বিচার বিভাগ। যখন এই শেষ আশ্রয়স্থলের বিচারকগণ দুর্নীতির মাধ্যমে রায় বিক্রি করেন, তখন সাধারণ মানুষের আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। জনগণ হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে বিকল্প খোঁজে। তখনি জনগণ মাস্তান, সন্ত্রাসী এবং বিভিন্ন মাফিয়া নেতাদের আশ্রয় নেয়। আদালত বলেছেন, এখন সময় এসেছে বিচার বিভাগ তথা জনগণের শেষ আশ্রয়স্থলকে আমূল সংস্কার করে, দুর্নীতির মূল উৎপাটন করে সত্যের নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য এবং আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার।
আদালত বলেন, আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগীয় দুর্নীতি পাশাপাশি চলতে পারে না। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে আইনের শাসন বই পুস্তকেই সীমাবদ্ধ থাকবে এটি কখনই বাস্তব রূপ লাভ করবে না।
বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রায়ে এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। রায়ে রাজধানীর কাকরাইলের ৫৬/৫৭ হোল্ডিংয়ের জমিসহ সম্পত্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে উল্লেখ করে এই সম্পত্তি প্রতিবন্দীদের কল্যাণে ব্যবহারের জন্য তা নিউরো ডেভেলপমেন্ট প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের অনুকূলে দখল বুঝিয়ে দিতে ঢাকা জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
গত বছর ১১ ডিসেম্বর এ রায় ঘোষণা করা হলেও পূর্ণাঙ্গ রায় শনিবার সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালে ঢাকা প্রথম সেটেলমেন্ট আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে গতবছর রাষ্ট্রপক্ষের করা পৃথক দুটি রিট আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে এ রায় দেন আদালত। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েশ আল হারুনী। বিবাদীপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট সিহাব উদ্দিন মাহমুদ।
রায়ের কপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দেশের সকল জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই সম্পত্তির মূল্য হাজার কোটি টাকা উল্লেখ করে আদালত বলেছেন, জনগন তথা রাষ্ট্র তথা দেশের হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত নূন্যতম দালিলিক এবং মৌখিক সাক্ষ্য-প্রমাণ ব্যতিরেকে জালিয়াত, ঠক, বাটপার এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসরদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
এ রায়ের বিষয়ে অ্যাডভোকটে সিহাব উদ্দিন মাহমুদ ও জমির মালিকানা দাবিদারদের একজন আসিফ রহমান ইমন কালের কণ্ঠকে বলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষনিক করা আবেদন আপিল বিভাগ গত জানুয়ারিতে স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। এখন হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পেলে আপিল করা হবে বলে জানান আসিফ রহমান ইমন।
আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হলে প্রথমেই দুর্নীতিবাজ বিচারকদের অনতিবলিম্বে এবং দ্রুততার সাথে উপড়ে ফেলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। তা না হলে নষ্ট বিচারক, পচা বিচারক এবং দুর্নীতিবাজ বিচারকরা ভাল বিচারকদের আস্তে আস্তে নষ্ট করে ফেলবে। আদালত বলেন, দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ আইনের শাসনের অন্যতম মূল শর্ত। দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ ছাড়া আইনের শাসন কল্পনাও করা যায় না। সুতরাং দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ গড়তে সংশ্লিষ্ট অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় ভাল বিচারকরাও ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সমূহ শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। রায়ের তথ্য মতে, ১৯৮৮ সালে কে এ এম আশরাফ উদ্দিন কাকরাইলের ৫৬/৫৭ হোল্ডিংয়ের ছয় কাঠা (বাড়ি নং-৫৬), লুৎফুন্নেছা রহমান চার কাঠা (বাড়ি নং-৫৬/১) এবং ১৯৮৯ সালে এ কে এম ইদ্রিস হোসেন তালুকদার ও তার স্ত্রী জামিলা খাতুন সাড়ে ছয় কাঠা (বাড়ি নং-৫৭) জামির মালিকানা দাবি করে পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে সেগুলো বাতিল চেয়ে সেগুনবাগিচার সেটেলমেন্ট আদালতে আবেদন করেন।
আবেদনকারীরা সবাই দাবি করেন, তারা ১৯৭৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী তারারাম জয়সুরিয়া ওরফে চিও রতন ওরফে তারারাম মুচির কাছ থেকে এই জমি কিনেছেন। পরে ১৯৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ১৬ কাঠা জমি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত রায় দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় পৃথক দুটি রিট আবেদন করে। আদালত রুল জারি করেন। এই রুলের ওপর শুনানি শেষে ওই সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।
আপনার মতামত জানানঃ