বিশ্বের বহু দেশে বর্তমানে দেখা দিচ্ছে ব্যাপক খাদ্য সংকট৷ নতুন করে খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন আরও বহু মানুষ। এমতাবস্থায় এক দশকের মধ্যে বিশ্বে খাবারের দাম সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। এসব মিলিয়ে বিশ্বের অনেক মানুষই খাদ্য সংকটে ভুগছে।
শক্তিশালী আরব বিশ্বের ৪২ কোটি জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরই খাওয়ার মতো যথেষ্ট খাবার নেই বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। বৃহস্পতিবার (১৬ ডিসেম্বর) জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে একথা জানানো হয়েছে।
এফএও এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৯ ও ২০২০ সালের মধ্যে আরব বিশ্বে অপুষ্টির শিকার মানুষের সংখ্যা ৪৮ লাখ থেকে বেড়ে মোট ছয় কোটি ৯০ লাখে দাঁড়িয়েছে। যা মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৬ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই পরিস্থিতির নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘায়িত সংকট, সামাজিক অসন্তোষ এবং সংঘাত, দারিদ্র, বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব ও সাম্প্রতিক করোনা মহামারি সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক চাপের মতো একাধিক সংকট প্রকট হয়ে ওঠা।
এফএও বলেছে, ‘সব আয়ের এবং সংঘাত কবলিত ও সংঘাতহীন সব এলাকার মানুষের মধ্যেই অপুষ্টির মাত্রা বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও ২০২০ সালে প্রায় ১৪ কোটি ১০ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত খাবার পায়নি—যা ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ১০ লাখ বেশি।’
এফএও এর সহকারি মহাপরিচালক আবদুল হাকিম এলওয়ায়ের বলেন, প্রাথমিক শর্তগুলো নিম্নমুখী হতে থাকায় এই বছর পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কোনও কারণ দেখা যাচ্ছে না।
ইয়েমেন সংকট সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাসীর মনে দাগ কেটেছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এটি কেবল একটি যুদ্ধাহত দেশ নয়। বর্তমানে ইয়েমেন স্মরণকালের সর্বোচ্চ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে, যা থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনো উপায়ই দেখা যাচ্ছে না। যত দিন যাচ্ছে, ততই ইয়েমেন সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আর বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের ফলে দেশটি বর্তমানে ইতিহাসের চরম মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে। অচিরেই এই যুদ্ধ থামানো না গেলে বিশ্ব একটি মানবসভ্যতাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। ক্ষমতা আর আধিপত্যের লোভে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে ইয়েমেন। আরব বিশ্বের সুন্দর এই দেশটিতে সৌদি আরব ও ইরানের ভূমিকা দেশটির হাজার হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করছে, যার অধিকাংশই রয়েছে নারী ও শিশু। যুদ্ধ, রোগ ও চরম দুর্ভিক্ষের কারণে দেশটির অধিকাংশ শিশু মরছে। আর জীবিতরা খাবার ও চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। আরব বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্র ইয়েমেনে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গৃহযুদ্ধের কারণে আজ পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ক্ষমতার লড়াই দেশের জন্য কতটা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে আধুনিক সমাজে ইয়েমেন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, যুদ্ধে বিধ্বস্ত ইয়েমেনে ইতোমধ্যে ৫০ হাজার মানুষ খাবারের অভাবে মারা গেছে। আরও দেড় কোটির বেশি মানুষ অনাহারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আরও কমপক্ষে ৫০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে।
সংস্থাটির প্রধান ইয়েমেনের মানবিক সংকট নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বলেছেন, ‘খাদ্যদ্রবের মূল্যবৃদ্ধি ও জ্বালানি স্বল্পতা নিয়ে পরিস্থিতি এখন বিপর্যয়কর। দুর্ভিক্ষের দরজায় কড়া নাড়ছে এমন মানুষের সংখ্যা ৫০ লাখ। আরও এক কোটি ৬০ লাখ অনাহারের মুখে।
ইয়েমেনে ডব্লিউএফপির মুখপাত্র আন্নাবেল সিমিংটন বলেন, ‘ইয়েমেনের মানুষ দুবেলা খাবার জোটাতে পারছে না। খাদ্যসংকট জটিল আকার ধারণ করলেও এর প্রভাব স্পষ্ট। ইয়েমেনি রিয়ালের মান কমে যাওয়া এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ ইয়েমেনিদের পক্ষে দুবেলা দুমুঠো খাবারের ব্যবস্থা করা অসাধ্য হয়ে পড়েছে।’
সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান হামলায় হুদাদিয়াহ বন্দর ধ্বংসের পর ইয়েমেনের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অনাহারে মারা যাচ্ছে দেশটির শিশুরা। জাতিসংঘ বলছে, বন্দরটি যদি ব্যবহারের উপযোগী না থাকে, তবে শিশুসহ লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটবে।
ইরাক এবং সিরিয়ায় ভয়াবহ সংকটে দিন কাটাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। সিরিয়া ও ইরাকে ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ পানি, খাদ্য ও বিদ্যুৎ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সম্প্রতি মানবিক সহায়তা বিষয়ক ১৩টি সংগঠনের সমন্বয়ে তৈরি করা এক প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে।
২০১৯ ও ২০২০ সালের মধ্যে আরব বিশ্বে অপুষ্টির শিকার মানুষের সংখ্যা ৪৮ লাখ থেকে বেড়ে মোট ছয় কোটি ৯০ লাখে দাঁড়িয়েছে। যা মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৬ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, কম বৃষ্টিপাত ও খরার কারণে সিরিয়া ও ইরাকের অনেক মানুষ খাবার পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়াও কৃষি জমির জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছেন না তারা। সব মিলিয়ে গত ৭০ বছরের মধ্যে ভয়াবহ খরা পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে সিরিয়া। ফলে তীব্র পানি সংকট মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
ভয়ঙ্করতম প্রভাব বিস্তার করে চলেছে জলবায়ু পরিবর্তন। ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতম তার প্রভাব পড়ছে গোটা বিশ্বে। গবেষকরা এই নিয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা জানিয়েছে। সবচেয়ে বিপন্ন পরিস্থিতি হতে চলেছে সিরিয়া ইরাক এবং ইরানে। সেখানে ভয়াবহ আকার নেবে জলবায়ু পরিবর্তন। ইরাক এবং ইরানকে প্রবল খরার মধ্যে পড়তে হবে। যার জন্য প্রবল খাদ্য সংকট তৈরি হবে এই তিন দেশে। একেবারে খাবারের জন্য হাহাকার পড়ে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন, পানির অব্যবস্থাপনা ও অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ভবিষ্যতে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। ওয়াটার রিসোর্সেস ইন্সটিটিউটের (ডব্লিউআরআই) পরিচালক চার্লস আইসল্যান্ড জানান, খাদ্য উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীলতা গড়ে তোলার উদ্দেশে ইরান, ইরাক ও জর্ডানসহ কিছু মধ্যপ্রাচ্যের দেশ প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে জমিতে সেঁচ দিচ্ছে। একইসঙ্গে অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন থামানো বা এর গতিকে ধীর করে দেওয়ার জন্য অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আসছে নভেম্বরে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (কপ–২৬)। এই সম্মেলনেও আগের ধারাবাহিকতা চালু থাকবে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
সহিংসতায় জর্জরিত অঞ্চলগুলিতে শুধু ফসল নষ্ট হয়, কৃষিকাজে ব্যবহৃত প্রাণীদের চুরি বা মেরে ফেলা হয় ও স্থানীয় জনগণ ঘরছাড়া হয়ে পড়ে৷ পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষকদের সংগঠন ইএসএএফএফ-এর মুখপাত্র জো এমজিঙ্গা বলেন, ‘যুদ্ধের সময়ে আমরা স্বাভাবিক উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারিনা৷ বাজারে অংশগ্রহণও স্বাভাবিক থাকে না’।
বিশ্বের যে ১০টি দেশে ক্ষুধা ও অপুষ্টির সমস্যা সবচেয়ে প্রকট, সেই দশটির মধ্যে আটটি দেশেই এই সংকটের মূল কারণ সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা, জানাচ্ছে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক৷ এর সাথে, যত বেশি উগ্র ও ভয়াবহ হচ্ছে সহিংসতার ধরণ, তত বেশি কঠোর হচ্ছে খাদ্যের অভাব৷
শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে খাদ্যের অভাব থেকেও জন্ম নিতে পারে সহিংসতার পরিবেশ৷ খাদ্য পণ্যের দখল নিয়ে যত বেশি প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে, যত বেশি করে এই দ্বন্দ্বে এসে জুড়বে ধর্ম, ভাষাভিত্তিক সংঘর্ষ, তত বেশি প্রকট হবে খাদ্য সংকট, এমনটাই মত ২০১৭ সালের বিশ্ব খাদ্য প্রোগ্রামের একটি গবেষণার৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, সামরিকতন্ত্রী রাষ্ট্র ও যুদ্ধবাজ মানুষের অমানবিক ও সহিংস তাণ্ডবে বিশ্বের বহু দেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিক মৃত্যু ও রক্তপাতে নিপতিত, যারা খাদ্যের সংস্থান করা তো দূরস্থিত, জীবন বাঁচাতেই মরিয়া। রণাঙ্গনে, শরণার্থী শিবিরে, পথে পথে সংঘাতদগ্ধ এইসব বিপুল ভাসমান মানুষের জীবন কাটে অনাহারে, অর্ধাহারে, খাদ্যহীনতায়।
সুষম বণ্টন আর শান্তি বিরাজমান থাকলে বিপুলা এই পৃথিবীর উর্বর ভূমিতটে উৎপাদিত খাদ্যের দ্বারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য অন্ততপক্ষে এক মুঠো ভাত জুটতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু শোষণ, লুণ্ঠন, যুদ্ধ, দখল, রক্তপাতের ফলে তা হচ্ছে না। হিংসা, হানাহানি ও লুটপাটের তাণ্ডবতায় শান্তি, স্থিতি, নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে মানুষের মুখের গ্রাস।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ