উত্তর কোরিয়ায় পাঁচ মিনিট ‘নিষিদ্ধ’ সিনেমা দেখায় কিশোরের ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার বৈরিতার বলি হলো এই কিশোর। প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদপুষ্ট দক্ষিণ কোরিয়া আর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্তরসূরি রাশিয়া ও নতুন ধারার চীনের সমর্থনপুষ্ট উত্তর কোরিয়ার মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলছে এই বৈরী সম্পর্ক।
দক্ষিণ কোরিয়ার নির্মিত একটি সিনেমা মাত্র পাঁচ মিনিট দেখায় উত্তর কোরিয়ার এক কিশোরকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার অনলাইন সংবাদমাধ্যম ডেইলি এনকে’র বরাত দিয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যম ডেইলি স্টার ও ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টাইমস এ খবর নিশ্চিত করেছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার কিম হিউং-জিন পরিচালিত ‘দ্য আঙ্কেল’ সিনেমাটি মাত্র পাঁচ মিনিট দেখেছিলেন ইয়াঙগান প্রদেশের হাইসান শহরের এলিমেন্টারি ও মিডল স্কুলের ১৪ বছরের এক শিক্ষার্থী। উত্তর কোরিয়ায় নিষিদ্ধ ওই সিনেমা দেখার অভিযোগে চলতি বছরের ৭ নভেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়।
অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ডেইলি এনকে জানায়, এই ঘটনায় ওই ছাত্রের মা-বাবাকেও শাস্তি দেওয়া হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট মহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তবে উত্তর কোরিয়ায় সংবাদমাধ্যমের অবাধ প্রবেশের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থাকায় বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
প্রচলিত রক্ষণশীল সাংস্কৃতিক রীতি লঙ্ঘনকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার জন্য উত্তর কোরিয়ার কুখ্যাতি আছে। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার কাছে ‘শত্রুভাবাপন্ন দেশ’ যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার কোনো সাংস্কৃতিক বিষয়বস্তু দেশটিতে আনা কিংবা দেখা নিষিদ্ধ।
কয়েকদিন আগেই দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় সিরিজ স্কুইড গেমের কপি দেশে আনা ও বিক্রির দায়ে একজন উত্তর কোরিয়ান হাইস্কুল ছাত্রকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে দেশটির সরকার।
বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত উত্তর কোরিয়া
প্রসঙ্গত, উত্তর কোরিয়ায় কিছুদিন আগে নতুন একটি আইন পাশ হয়েছে, যার উদ্দেশ্য যে কোন ধরণের বিদেশি প্রভাব প্রতিহত করা। এই আইনে বলা হয়েছে, কেউ যদি ভিনদেশি সিনেমা দেখে, ভিনদেশি পোশাক পরে, এমনকি গালিও দেয়, তবে তাকে কঠোর শাস্তির মুখে পড়তে হবে।
উত্তর কোরিয়ায় ইন্টারনেট নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢোকার সুযোগ নেই। তথ্য পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম গুটিকয়েক রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেল, যেগুলো আপনাকে সেটাই শুধু বলে, যেটা দেশের নেতারা আপনাকে শোনাতে চায়। এই হলো উত্তর কোরিয়ার জনজীবন।
আর এখন কিম জং-আন নতুন এক আইন দিয়ে আরও চেপে ধরতে চাইছেন, যে আইনটি “প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা” রুখে দেয়ার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এখন কেউ যদি দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা কিংবা জাপানী কোন ভিডিও’র বড় চালানসহ ধরা পড়েন, তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। কেউ যদি ওই ভিডিও দেখা অবস্থায় ধরা পড়েন, তবে তার শাস্তি ১৫ বছরের কারাদণ্ড।
এই আইনটির একটি কপি পেয়েছিল দ্য ডেইলি এনকে। এতে বলা আছে, যদি একজন শ্রমিক ধরা পড়ে, তাহলে কারখানার প্রধানকেও কারাদণ্ড দেয়া যাবে। যদি একটি শিশুর সমস্যা থাকে তাহলে তার পিতামাতাকেও সাজা দেয়া যাবে।
বিবিসিকে দ্য ডেইলি এনকের প্রধান সম্পাদক লি স্যাং ইয়াং বলেন, উত্তর কোরিয়ার তরুণদের যদি দক্ষিণের প্রতি বিন্দুমাত্র আকাঙ্ক্ষাও থাকে, এতটুকু স্বপ্নও থাকে মনের গহীনতম কোণে, তাহলে তা ‘ভেঙে-গুড়িয়ে’ দেয়াই আইনটির উদ্দেশ্য।
গত বছর যেসব পক্ষ ত্যাগকারী উত্তর কোরিয়া থেকে বেরিয়ে আসার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন তাদের একজন চই জং-হুন। বিবিসিকে তিনি বলেন, সময় যত কঠিন হয়, বিধি-বিধান, আইন ও শাস্তি তত কঠোর হয়।
তিনি বলেন, মনস্তাত্বিকভাবে, আপনার পেট যখন ভরা থাকে তখন আপনি যদি একটি দক্ষিণ কোরিয়ার সিনেমা দেখেন, সেটা আপনার অবসর বিনোদন হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু যখন সেখানে খাবারই নেই, টিকে থাকাটাই দুষ্কর, মানুষের জন্য তখন আর সেটা বিনোদন থাকে না।
সুদীর্ঘ বৈরী সম্পর্ক
৩৯ বছর আগে দুই ভিয়েতনাম এবং ২৬ বছর আগে দুই জার্মানি একত্র হয়। দৃশ্যত প্রায় ২৫ বছর আগে শীতলযুদ্ধের অবসান হলেও সুদীর্ঘ ৬০ বছর পরও দুই কোরিয়ার বৈরিতার অবসান হয়নি। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে পুরো কোরিয়া উপদ্বীপ জাপানের শাসনের কবল থেকে মুক্তিলাভ করে।
এরপর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এই উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও দক্ষিণাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু সদ্য মুক্ত কোরিয়ার জনগণ নতুন করে পরাধীন থাকতে চায়নি। দুই অঞ্চলেই বিদ্রোহ-আন্দোলন চলতে থাকে। কিন্তু কোনোটাই সফল হয়নি। অবশেষে ১৯৪৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ‘উত্তর কোরিয়া’ ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ‘দক্ষিণ কোরিয়া’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৩ সালের মধ্যে দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ হয় অস্ত্রবিরতির মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে কোনো শান্তিচুক্তি হয়নি। ফলে কৌশলগত দিক দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া কমপক্ষে অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থেকেই যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার বৈরিতা কেবল এই দুই দেশের জন্যই সংকট নয়; বরং এটি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্যও বিরাট হুমকি। শীতলযুদ্ধের স্পষ্ট প্রভাব কোরিয়া উপদ্বীপে এখনো বর্তমান।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ