পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বনাঞ্চল আমাজন। বনাঞ্চলটি এতো বড় যে, দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে পৃথিবীর নবম বৃহত্তম দেশ হতো আমাজন। যুক্তরাজ্য এবং আয়ারল্যান্ড অনায়াসে ১৭ বার রাখা যাবে এ বনাঞ্চলে। ৯টি দেশ মিলে বিস্তৃত এই বন। এটি একটি এমন ইকোসিস্টেম যা পুরো পৃথিবীর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। এত বড় বনাঞ্চল ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে।
আমাজন বন উজাড়ে পরোক্ষভাবে বড় বড় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর দায় রয়েছে। কারণ, আমাজন বন উজাড়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন ও অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে ব্র্যান্ডগুলোর ব্যবসায়িক সংযোগ আছে। সাপ্লাই চেইন রিসার্চ ফার্ম স্ট্যান্ড ডট আর্থের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। খবর দ্য গার্ডিয়ানের।
গত সোমবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন তৈরিতে ৫ লাখ তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়। এতে দেখা যায়, আমাজন বন উজাড় করছে এমন শিল্পের সঙ্গে ব্যবসায়িক সংযোগ রয়েছে কোচ, লুই ভুঁইতো, প্রাডা, এইচঅ্যান্ডএম, জারা, অ্যাডিডাস, নাইকি, নিউ ব্যালান্স, তেভা, ইউজিজি ও ফেন্দির মতো ব্র্যান্ডগুলোর। যেমন ৫০টির বেশি বড় ব্র্যান্ডের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে ব্রাজিলের বৃহত্তম মাংস প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানি জেবিএসের। জেবিএস সম্প্রতি ২০৩৫ সালের মধ্যে বন উজাড় বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি নিয়েছে। তবে তাদের এই পদক্ষেপ পরিবেশবাদী গোষ্ঠীগুলো অপর্যাপ্ত বলছে।
সাপ্লাই চেইন গবেষণা ফার্ম স্ট্যান্ড.আর্থ(stand.earth) পরিচালিত এই গবেষণায় বলা হয়, ভিএইচএম, প্রাডা, জারা, কোচ, এইচ অ্যান্ড এম, নাইকি, অ্যাডিডাস, নিউ ব্যালেন্স, টেভা, ইজিসি ও ফেন্ডির মত ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাদের পণ্যের জন্য যেসব জায়গা থেকে চামড়া সংগ্রহ করে, সেসব চামড়া কারিগরদের কাজের সঙ্গে আমাজন বন নিধনের যোগসূত্র রয়েছে।
তবে আমাজন ধ্বংসের সাথে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর সরাসরি সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা গবেষণায় দেখানো হয়নি, জানিয়েছে সিএনবিসি।
স্ট্যান্ড আর্থের প্রতিবেদনে সহযোগিতা করেছে জলবায়ু নিয়ে কর্মরত অলাভজনক সংস্থা স্লো ফ্যাক্টরি। স্লো ফ্যাক্টরি প্রতিবেদনে লেখে, ‘আপনি যদি একটা লেদারের জুতা বা বেল্ট পরেন কিংবা লেদারের হাতব্যাগ বহন করেন, তাহলে ধরেই নেওয়া যায় এটি গরুর চামড়া থেকে তৈরি যা আমাজন রেইনফরেস্টকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে’।
প্রতিবেদনে ৮৪টি কোম্পানি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে স্ট্যান্ড আর্থ। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ কোম্পানিই এ বিষয়ে নিয়মভঙ্গ করেছে।
এটি আরও জানায়, বন উজাড় বিষয়ে স্পষ্ট নিয়ম থাকা সত্ত্বেও ২৩টি ফ্যাশন ব্র্যান্ড তাদের নিজস্ব নিয়ম ভঙ্গ করেছে।
বেশিরভাগ ব্র্যান্ডই বেশকিছু ট্যানারি ও উৎপাদনকারীর সাথে চুক্তিবদ্ধ রয়েছে, যারা কিনা আমাজন রেইনফরেস্টে পালিত গরু নিয়ে কাজ করে।
সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের তথ্যানুযায়ী, পঞ্চাশটিরও বেশি ব্র্যান্ডের জেবিএস-এর সাথে সাপ্লাই চেইন সংযোগ রয়েছে। জেবিএস ব্রাজিলের সর্ববৃহৎ চামড়া রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। আমাজনে অবৈধভাবে বন উজাড়ে ব্যস্ত কৃষকদের সাথে এই প্রতিষ্ঠানটির সরাসরি সংযোগ রয়েছে।
প্রতিবেদনের অন্যতম গবেষক গ্রেগ হিগস বলেছেন, ‘সমীক্ষায় পাওয়া এক-তৃতীয়াংশ কোম্পানির একরকম নীতি আছে। এতে আশা করা যায় যে বন উজাড় বন্ধের ওপর প্রভাব পড়বে। তবে দেখা যাচ্ছে বন উজাড়ের হার বাড়ছে, তাই নীতিগুলোর কোনো বস্তুগত প্রভাব নেই।’
গত ২০১৯-২০ সালে দাবানল থেকে আমাজন বনকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে ব্রাজিলের ভূমিকা বিশ্বনেতাদের সমালোচনার মুখে পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, গবাদিপশু শিল্প আমাজন বন উজাড়ে অন্যতম ভূমিকা রাখছে। এই শিল্প ফ্যাশন শিল্পের চামড়া সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ভিএইচএম, প্রাডা, জারা, কোচ, এইচ অ্যান্ড এম, নাইকি, অ্যাডিডাস, নিউ ব্যালেন্স, টেভা, ইজিসি ও ফেন্ডির মত ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাদের পণ্যের জন্য যেসব জায়গা থেকে চামড়া সংগ্রহ করে, সেসব চামড়া কারিগরদের কাজের সঙ্গে আমাজন বন নিধনের যোগসূত্র রয়েছে।
গবেষণার দেখা গেছে, ভোক্তাদের মানিব্যাগ, হ্যান্ডব্যাগ ও জুতা সরবরাহ অব্যাহত রাখতে, ফ্যাশন শিল্পকে ২০২৫ সালের মধ্যে বার্ষিক ৪৩ কোটি গরু জবাই করতে হবে। তাদের বিশ্লেষণ বলছে, আমাজন বন উজাড়ে প্রতিটি ফ্যাশন ব্র্যান্ডের সরাসরি যোগসূত্র আছে এমন প্রমাণ করে না, তবে পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৮৪টি কোম্পানির মধ্যে ২৩টিরই বন উজাড়ের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট নীতি আছে। তবে তারা তাদের নিজস্ব নীতিই লঙ্ঘন করছে। উদাহরণস্বরূপ ফ্যাশন হাউস লুই ভুঁইতোর কথা তুলে ধরা হয়। আমাজন বন উজাড় করে এমন কোম্পানির সঙ্গে তার সংযোগ উচ্চ ঝুঁকির সৃষ্টি করছে। অথচ সম্প্রতি ব্র্যান্ডটি ইউনেসকোর সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
গবেষণার লেখকদের একজন অ্যাঞ্জেলিন রবার্টসন দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এই জরুরি অবস্থার সময়ে যদি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি কোনো ভূমিকা রাখতে চায়, তবে এটাই সুযোগ’।
স্লো ফ্যাক্টরি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা সেলিন সেমান বলেন, ব্র্যান্ডগুলোর উচিত এমন জায়গায় বিনিয়োগ করা যারা পরিবেশ দূষিত করবে না। চামড়া সংগ্রহের জন্য দিনশেষে আমাদের একটা বিকল্প খুঁজতেই হবে যা কিনা প্রাণীজ ও প্লাস্টিকভিত্তিক হবে না।
১ কোটি বছর পুরনো আমাজন বন আজও প্রাণীবৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ যেখানে রয়েছে ৩৯ হাজার কোটি গাছ। বছরের পর বছর ধরে কৃষিজমি, মানুষের বাড়িঘর বা আগুনের ফলে আমাজন বন উজাড় হয়ে চলেছে।
ব্রাজিলের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চের পক্ষ থেকে বলা হয়, গত অক্টোবরে আমাজনের ৮৭৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকার বন উজাড় করা হয়েছে। এটি ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও শহরের অর্ধেক। ২০২০ সালের অক্টোবরের চেয়ে চলতি বছরের একই সময়ে আমাজনে বন উজাড় পাঁচ শতাংশ বেড়েছে।
অবৈধ খনন এবং কৃষিকাজের জন্য ২০২০ সাল থেকে আমাজনে বন উজাড় বেড়েছে। চলতি বছর এই পরিমাণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। ২০২১ সালে এ পর্যন্ত আমাজনের সাত হাজার ৮৮০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার বন উজাড় করা হয়েছে।
গ্লাসগো সম্মেলনকে ঘিরে ২০৩০ সালের মধ্যে বনভূমি নিধনের ইতি টানতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিল অন্যতম। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির প্রেসিডেন্ট বলসোনারো ২০২৮ সালের মধ্যে অবৈধভাবে বন উজাড় ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কিন্তু পরিবেশবাদি সংগঠনগুলো বলছে, বলসোনারোর আমলেই খনন কাজ আর কৃষি জমি তৈরির জন্য বননিধন বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এই প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে সন্দিহান তারা।
গ্রিনপিস আমাজন ক্যাম্পেইনের মুখপাত্র রোমুলো বাতিস্তা বলেন, বননিধন এবং আগুন লাগার ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং আদিবাসী ও স্থানীয়দের মধ্যে সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। এই প্রতিশ্রুতি আদৌ বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন করবে না।
আইএনপিইর তথ্য-উপাত্ত বলছে, আমাজনে শুধু অক্টোবরেই ১১ হাজার পাঁচশর বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ছিল ১৭ হাজার তিনশ। কিন্তু ২০১৯ সালের পর এসব ঘটনা দ্রুত বেড়েছে এবং তখন ছিল সাত হাজার নয়শটি।
২০১৯ সালে জাইর বলসোনারো ক্ষমতায় বসার পর আমাজনের ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার খোয়া গেছে এক বছরেই, যার আয়তন প্রায় লেবাননের সমান। গত দশকে এটা ছিল ৬ হাজার পাঁচশ বর্গকিলোমিটার।
পাঁচ দশক ধরে মানুষ এই অরণ্যকে সংকুচিত করে চলেছে অপরিণামদর্শিতার সঙ্গে। ৫৫ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর আগেও আমাজন অরণ্যের অস্তিত্ব ছিল বলে ভূতত্ত্ববিদদের অভিমত। এর জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকান প্লেট (আটলান্টিক ওশানে মেজর টেকটোনিক প্লেট, যার মধ্যে পুরো দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ রয়েছে এবং এটি আফ্রিকান প্লেট পর্যন্ত বিস্তৃত) এবং নাজকা প্লেটের সংঘর্ষে যখন আন্দিজ পর্বতমালার সৃষ্টি হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য রয়েছে আমাজনের জঙ্গলে। সত্তর দশকের কিছু আগেও এর আয়তন ছিল ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার (২১ লাখ ২৩ হাজার ৫৬২ বর্গমাইল)। সত্তর দশকে আয়তন পরিমাপ করা হয় ৪১ লাখ বর্গকিলোমিটার। নব্বইয়ের মধ্যভাগে মহা অরণ্যের বিরাট শরীর আরও বেশি সংকুচিত হয়ে পড়ে।
অরণ্য সুরক্ষায় তখনকার ব্রাজিলিয়ান সরকার ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব মিলে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু এই অসাধারণ ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্টের করুণ পরিণতি তাতে ঠেকানো যায়নি। অবৈধ ও বৈধ—দুভাবেই ক্রমাগত বিস্তীর্ণ বনভূমি উজাড় হতে থাকে।
বিশ শতক থেকে যেভাবে সারা বিশ্বে অরণ্যভূমি বিনষ্ট করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, অতীতে সেভাবে কোনো দিনও হয়নি। বরং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা বজায় রেখে হাজার হাজার বছর ধরে অরণ্যবাসী মানুষ ও বন্য প্রাণী বসবাস করে এসেছে অরণ্যের অভ্যন্তরে। এরপর জনসংখ্যা যত বেড়েছে, জড়বিজ্ঞানের প্রবল প্রতাপ যত বেশি আকাশচুম্বী হয়েছে, ততই অরণ্য সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, যত বেশি বনাঞ্চল ধ্বংস হবে, তত বেশি মারণ ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ, বনভূমি হল মানুষ ও ভাইরাসের মাঝে ঢাল। এমনটা আগেই জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। বন্য প্রাণীর শরীরে থাকা অজানা ভাইরাস ছড়ানো রোধ করতে হলে বনাঞ্চল ধ্বংস আটকাতে হবে সবার আগে।
তারা বলছেন, করোনার পরবর্তী ভাইরাস ছড়াতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্য আমাজন থেকে। কারণ সেখানে নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। আর সেটা সব থেকে চিন্তার বিষয় এখন।
সারা বিশ্বের ২০ শতাংশ অক্সিজেনের জোগান দেয় আমাজন বনভূমি। তার থেকেও বড় কথা, এই বনভূমিতে বহু নাম না জানা প্রাণীও রয়েছে। তাদের শরীরে রয়েছে অজানা প্রাণঘাতী ভাইরাস। সেই ভাইরাস একবার মানুষের মধ্যে ছড়াতে শুরু করলে বিপদ।
ব্রাজিলের পরিবেশ বিজ্ঞানী ডেভিড লাপোলা জানিয়েছেন, বনাঞ্চলে নগরায়ন করলে বিভিন্ন প্রাণী থেকে ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়ানো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমাজনের গভীর অরণ্যে বহু চেনা-অচেনা ভাইরাস রয়েছে। মানুষ বনাঞ্চল ধ্বংস করে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলে সেই ভাইরাসে সংক্রমিত হবে। আর আমাজন যেভাবে ধংস করা হচ্ছে তাতে এর পর সেখান থেকেই নতুন কোনও ভাইরাস ছড়াতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৩
আপনার মতামত জানানঃ