রাজধানীতে গতকাল সড়ক দুর্ঘটনায় নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে আজ নিরাপদ সড়কের দাবিতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সব মোড়ে অবস্থান নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে ঢাকা নগরী। এর মধ্যেই ঢাকায় উত্তর সিটি কর্পোরেশনের একটি গাড়ির চাপায় আজ বৃহস্পতিবারও এক মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনা সম্প্রতি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ছয় হাজার ৬৮৬ জন, যার মধ্যে ৭০৬ জন শিক্ষার্থী ও ৫৪১টি শিশু; যা মোট মৃত্যুর প্রায় ১৯ ভাগ।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গত সপ্তাহে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে উঠে আসে যে গত ১০ মাসে বাংলাদেশে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায় ১,৭৫৮ জন, যার মধ্যে ৬৪৯ জনই শিক্ষার্থী। অর্থাৎ গত ১০ মাসে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৩৭ ভাগই শিক্ষার্থী। এখানে প্রশ্ন উঠছে এতোটা বেপরোয়া কেন দেশের ড্রাইভাররা?
ছাত্র আন্দোলনে অচল ঢাকা
গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লার গাড়ির ধাক্কায় রাজধানীর গুলিস্তানে নটরডেম কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহত হন।
এরপর আজ বৃহস্পতিবার সকালে নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় দিনের মতো আন্দোলনে অংশ নিতে মতিঝিল শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন। এদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে রাজধানীর শান্তিনগর মোড়ে ভিকারুননিসা নূন কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন।
এছাড়া নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেট মোড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীদের অবস্থানে সড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। উত্তরাতেও সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রাজধানীতে পরিবহন চলাচল স্থবির হয়ে পড়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ‘বিচার চাই’, “ডিজিটাল নয়, নিরাপদ বাংলাদেশ চাই’, ‘আমার ভাই মরল কেন, জবাব চাই’ ইত্যাদি নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকে।
বুধবার দুর্ঘটনার পর পুলিশ নাঈম হাসানকে ধাক্কা দেওয়া ময়লার গাড়িটি জব্দ করে। গাড়ির চালককেও আটক করেছে পুলিশ। ঘটনার তদন্তে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এর আগে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে।
কেন ড্রাইভাররা এত বেপরোয়া?
সূত্র মতে, রাজধানীর গুলিস্তানে রাস্তা পারাপারের সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় গাড়িচালক রাসেল খান ছিলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। গাড়িটির প্রকৃত চালক ছিলেন মো. হারুন। হারুনের কাছ থেকে চাবি নিয়ে সায়েদাবাদ থেকে গাড়ি নিয়ে বের হয় রাসেল।
এই অনিয়ম আর ড্রাইভারদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোয় সড়কে মৃত্যুর ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ঝরছে অমূল্য প্রাণ। এ বছরের প্রথম সাত মাসে ৩ হাজার ২৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩ হাজার ৯৫ জন নিহত হয়েছেন। এ সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪০ শতাংশেরও বেশি। ২০২০ সালে দেশে চার হাজার ৭৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ৪৩১ জন নিহত এবং সাত হাজার ৩৭৯ জন আহত হন।
অথচ এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় গণ-পরিবহনে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার তেমন কোন ইতিহাস নেই। এমনকি রাজনীতি এবং চাঁদাবাজির কারণে সরকারের এই ধরনের উদ্যোগ অতীতে ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে থেকেই নস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে।
মূলত প্রশিক্ষিত ড্রাইভার না থাকা এবং চুক্তি ভিত্তিতে ড্রাইভারের হাতে বাস ছেড়ে দেয়ার জন্যই সড়কে নানা দুর্ঘটনা ঘটছে বলে পরিবহন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার কঠোর হতে চাইলেও, বাস-ট্রাকের মালিক ও শ্রমিকরা এ নিয়ে হরতাল শুরু করেন। ভাঙচুর করেন। ফলে সরকার ভয় পেয়ে যায়। সরকারের ভেতরে থাকা পৃষ্ঠপোষকদের জন্যই বাস মালিক এবং ড্রাইভাররা আজ এতটা বেপরোয়া আচরণ করছে।
সরকারি হিসেব মতে, সারা দেশে ৩২ লক্ষ গাড়ির সরকারি নিবন্ধন রয়েছে। কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে ২৫ লক্ষের। অর্থাৎ বিশাল সংখ্যক ড্রাইভার কোন অনুমতি ছাড়াই গাড়ি নিয়ে পথে নামছেন।
এই ব্যবধানের কারণ ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সড়ক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক শেখ মো. মাহাবুব-ই-রব্বানী জানান, বাস-ট্রাকের মতো ভারী গাড়ির লাইসেন্স নিতে মোট ছয় বছর সময় লাগে। ড্রাইভারদের প্রথমে হালকা গাড়ির লাইসেন্স নিতে হয়, তার তিন বছর পর মাঝারি গাড়ির লাইসেন্স নিতে হয়। ভারী গাড়ির লাইসেন্সের জন্য আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়।
তিনি জানান, এরপর যে ড্রাইভার বাস চালাতে চান তাকে পাবলিক সার্ভিস ভেহিকেল অথোরাইজেশন বা পিএসভি নামে ভিন্ন আরেকটি লাইসেন্স নিতে হয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ড্রাইভাররা এতটা সময় অপেক্ষা করতে চান না। তারা হালকা বা মাঝারি গাড়ির লাইসেন্স ব্যবহার করেই বাস চালান।
আর মালিকরাও তাদের মুনাফার স্বার্থে এটা মেনে নেন। দক্ষ ড্রাইভার না থাকার কারণেই বাসের হেলপাররাও এক সময় ড্রাইভিং সিটে বসার সাহস দেখায় বলে তিনি জানান। মালিকরা প্রায়শই প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকার বিনিময়ে তাদের বাসকে ড্রাইভারের হাতে তুলে দেন।
এসডব্লিউ/এসএস/২১৩৫
আপনার মতামত জানানঃ