আজানের সময় লাউডস্পীকারের ব্যাবহার একটা অতি পুরাতন এবং গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। কিন্তু বেশিরভাগ মসজিদ উচ্চ মাত্রার শব্দ এবং প্রচুর পরিমাণে লাউডস্পিকার ব্যবহার করার কারনে আজানের সময় ঐ এলাকায় জনসাধারণের দারুণ ভোগান্তি হয়। তাই বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ায় মসজিদের মাইকে আজান দেওয়া নিয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর আপত্তির মুখে এ ব্যাপারে আলোচনা করে সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে দেশটির ওলামা পরিষদ।
ইন্দোনেশিয়ান ওলামা কাউন্সিল সম্পতি এক ফতোয়ায় বলেছে, সমাজে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মতামতকে সম্মান জানাতে মসজিদে মাইকে আজান দেওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম হচ্ছে নামাজ। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের প্রধান অংশ আজান। তাই অত্যাবশ্যকীয়ভাবে প্রতিটি মসজিদ, যেখানে জামাতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা হয়, সেখানে প্রতি ওয়াক্ত নামাজের আগে আজান দিতে হয়। কিন্তু আজান প্রচারের সময় প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি লাউডস্পিকারের ব্যবহার হচ্ছে এবং এতে করে জনসাধারণ পড়ছে দুর্ভোগে। এই বিষয়টা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ।
প্রায় সব মসজিদেই মাইকে আজান দেওয়া হয়। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অনেক মসজিদের মাইকেই উচ্চমাত্রার এবং বিরক্তিকর শব্দ হচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়ার ওলামা পরিষদের এ আহ্বানকে স্বাগত জানিয়েছেন দেশটির ধর্মমন্ত্রী ইয়াকুত চলিল কৌমাস। মসজিদে মাইক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন ওলামারা। যাতে শব্দদূষণ না হয়, এ জন্য মাইকের যথাযথ ব্যবহার করতে হবে।
ওলামা পরিষদের নেতা ও ইন্দোনেশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট মারুফ আমিনের মুখপাত্র মাসদুকি বাইডলবি গণমাধ্যমকে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে মাইকের ব্যবহার জনসাধারণের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন আলেম সমাজ।
তিনি আরও বলেন, রাজধানী জাকার্তার মতো ইন্দোনেশিয়ার সব এলাকাই এখন ঘনবসতিপূর্ণ। তাই মাইকে সহনীয় মাত্রায় আজান দিতে হবে।
১৯৭৮ সালে দেশটির ধর্ম মন্ত্রণালয় মসজিদে মাইকে আজান দেওয়ার আইন প্রণয়ন করে ডিক্রি জারি করে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ মুসলিম দেশটিতে ৬ লাখ ২৫ হাজার মসজিদ আছে। দেশটির ২৭ কোটি জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই মুসলিম।
এর আগে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলমানদের দেশ ইন্দোনেশিয়াতে আজান ছাড়া মসজিদের মাইকে অন্য কোনও শব্দ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বিশেষ করে মানুষ যখন ঘুমাচ্ছে, বিশ্রাম নিচ্ছে অথবা নামাজ পড়ছেন। একই সঙ্গে নামাজের সময় মাইকের শব্দ না বাড়ানোর নির্দেশও দেওয়া হয়। আজানের উচ্চ শব্দ নিয়ে অভিযোগ করায় এক নারীকে কারাদণ্ড দেওয়ার সমালোচনার সময় ইন্দোনেশিয়ার ধর্ম মন্ত্রণালয় এসব নির্দেশনা জারি করে।
সম্প্রতি দেশটিতে আজানের উচ্চস্বর নিয়ে অভিযোগ করায় মেলিয়ানা নামের নারীকে ধর্ম অবমানায় কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে তার বাড়ির পাশের মসজিদে উচ্চস্বরের আজান নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন তিনি। কিন্তু গুজব ছড়ায় মেলিয়ানা আজান নিষিদ্ধ করতে চাইছেন। অনেক মুসলিম তখন বৌদ্ধদের মন্দিরে হামলা চালায়। ১৯৯৮ সালে চীনবিরোধী সহিংসতার পর এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সংঘাত।
মেলিয়ানার কারাদণ্ডের পর সিভিল সোসাইটি ও আইনজীবীরা রায়টি প্রত্যাখ্যান করেন। ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সংগঠন নাহদাতুল উলামা ঘোষণা দেয়, মাইকের আজানের উচ্চস্বর নিয়ে আপত্তি জানানো ধর্ম অবমাননার আওতায় পড়ে না। বরং এরকম আপত্তিকে গঠনমূলক সমালোচনা হিসেবেই দেখা উচিত।
প্রায় চার কোটি সদস্যের সংগঠন নাহদাতুল উলামার আইন বিভাগের প্রধান রবিকিন এমহাস বলেছিলেন, মাইকে দেওয়া আজানের শব্দ অনেক বেশি, এমনটা বললে তাকে ধর্ম অবমাননা হিসেবে গণ্য করা যায় না। বরং ইন্দোনেশিয়ার মতো একটি বহুত্ববাদী সমাজে এমন অভিযোগকে মুসলমানদের গঠনমূলক সমালোচনা হিসেবেই দেখা উচিত।
এদিকে অন্যে যেন বিরক্ত না হয় তাই সৌদি আরবে মসজিদে মাইক ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আজান ও ইকামাত ছাড়া মসজিদের মাইক ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটির ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি মাইকের আওয়াজ সীমিত করারও নির্দেশ দিয়েছে দেশটি।
নামাজের প্রথম আহ্বান আজান এবং দ্বিতীয় আহ্বানকে ইকামাত বলা হয়। ইকামাতের অর্থ ইমাম সাহেব জামায়াতে নামাজের জন্য কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন এবং নামাজ শুরু হতে চলেছে।
সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে একটি হাদিসের বরাত দেওয়া হয়েছে। ওই হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের সবাই সৃষ্টিকর্তাকে নীরবে ডাকছ। কেউ কাউকে বিরক্ত করা উচিত নয় এবং (সূরা) পাঠ বা নামাজে একজনের কণ্ঠের ওপর কণ্ঠ তোলা উচিত নয়।’
এ বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মসজিদের মাইকে আজানের মিষ্টি সূর অনেক বিধর্মির কাছেও মধুর। কিন্তু সেই আজান যদি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতির ঢাকা শহরে ৩০০ মিটার দূরে দূরে স্থাপিত মসজিদ থেকে আধুনিক মাল্টিপল হর্ন লাগানো কিলোওয়াট ক্ষমতার এম্পলিফায়ার ব্যবহার করে গগণ ফাটানো চিৎকারযোগে পরিবেশিত হয়, তবে তা আর মধুর আহ্বান থাকে না, রীতিমত টর্চারে পরিণত হয়। এক মসজিদে ঐ শব্দযন্ত্রণা শুরু হবার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় নিকটবর্তি সব মসজিদের সন্মিলিত চিৎকার। এতে শব্দ দূষণের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক শৃঙ্খলাও বিঘ্নিত হয়। মসজিদের মাইক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
অতীতের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে মসজিদের মাইক ব্যবহার করে নানা দাঙ্গা ফ্যাসাদের সৃষ্টি হয়। গুজব ছড়িয়ে মানুষ হত্যার প্রতিযোগিতায় নামে। মসজিদের মাইকে প্রচারিত যেকোনো বার্তারই সাধারণ মানুষের নিকট ভিন্ন রকম এক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে যা ধর্মীয় আবেগের সাথে সংশ্লিষ্ট।
তাদের মতে, আমাদের দেশেও মসজিদের মাইক ব্যবহার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকা দরকার। যেসব মসজিদ ও মাদ্রাসা হতে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়—সেসব মসজিদ ও মাদ্রাসার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন থাকা উচিত।
তারা আরও বলেন, ধর্মকে ব্যবহার করে কেউ যেন কখনো এই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করার সাহস না করে তার সবরকম আইনগত ভিত্তি থাকা উচিত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৫
আপনার মতামত জানানঃ