এখন থেকে ১৮ বছর আগে সামরিক অভিযানে ইরাক দখলের পর সেদেশে আমেরিকার সৈন্য সংখ্যা ছিল ১৬০,০০০। আর এখন সরাসরি সামরিক তৎপরতায় অংশ নিচ্ছে বা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত তেমন মার্কিন সৈন্যের সংখ্যা মাত্র ২৫০০। এছাড়া, আইএস-এর মোকাবেলায় বেশ কিছু মার্কিন স্পেশাল ফোর্স ইরাকে তৎপর রয়েছে যদিও সংখ্যা অজানা।
প্রসঙ্গত, এই যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা আনুমানিক ১৫০,০০০ থেকে ১০ লক্ষের বেশি। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে ৮৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়েও বেশি, আর যুক্তরাজ্যের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন ইউরো।
সৈন্য প্রত্যাহার
চলতি বছর শেষের আগেই ইরাকে সামরিক মিশন সম্পন্ন করবে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল শনিবার (২০ নভেম্বর) ইরাকের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জুমাহ ইনাদের সঙ্গে বৈঠকে এই তথ্য জানিয়েছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন। এর আগে চলতি বছরের জুলাই মাসে ২০২১ সালের মধ্যেই ইরাকে সামরিক অভিযান সমাপ্তির ঘোষণা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
ওই সময়ই হোয়াইট হাউসে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা আল-খাদেমির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বৈঠকের পর জানানো হয়, চলতি বছরের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ইরাক থেকে দেশে ফিরে আসবে।
শনিবার এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, ‘চলতি বছরের মধ্যেই ইরাকে মার্কিন বাহিনীর সামরিক ভূমিকা শেষ করাসহ ২০২১ সালের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র-ইরাক কৌশলগত সংলাপের সকল প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কাজ করছে ওয়াশিংটন।’
সূত্র মতে,বাহরাইনের মানামায় বার্ষিক মানামা সংলাপের সাইডলাইনে ইরাকের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জুমাহ ইনাদ সুদান আল-জাবুরির সঙ্গে শনিবার বৈঠক করেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন। বৈঠকের পরই দেওয়া এক বিবৃতিতে চলতি বছরের মধ্যেই ইরাকে সামরিক মিশন সম্পন্নের কথা জানায় পেন্টাগন।
যেকারণে এমন সিদ্ধান্ত
অবশ্য এরপরও ইরাকের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া অব্যহত রাখবে ওয়াশিংটন। ইরাকে বর্তমানে আড়াই হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে এবং তাদের মূল কাজ হচ্ছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনীকে সহায়তা করা।
মূলত গত বছরের শুরুতে বাগদাদে ইরানের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানি এবং ইরান-সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীর কমান্ডারকে ড্রোন হামলার মাধ্যমে হত্যা করে মার্কিন বাহিনী। এরপর থেকে ইরাকে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি একটি বড় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
ইরান-ঘনিষ্ঠ ইরাকি রাজনৈতিক দলগুলো এরপর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সকল সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে। যদিও জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটকে ইরাকের জন্য এখনও হুমকি বিবেচনা করছেন অনেকে।
এর আগে গত বছরের শেষের দিকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য কমানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার এই ঘোষণার পর প্রায় ৫০০ সৈন্যকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। বর্তমানে ইরাকে অন্তত আড়াই হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে বলে গত জুলাই মাসে বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল।
অবশ্য ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। পরিবির্তিত পরিস্থিতিতে দেশটিতে নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি হয় এবং জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের উত্থান ঘটে। পরে ২০১৪ সালে আবারও দেশটিতে সেনা মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র।
লাভবান হবে ইরান
আমেরিকান সৈন্যরা চলে গেলে ইরানের যে লাভ হবে তা নিয়ে তেমন কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরানের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য আশপাশের দেশ ও অঞ্চল থেকে আমেরিকান সৈন্যদের বিদায় করা যাতে তারাই এই অঞ্চলে প্রধান শক্তি হতে পারে।
উপসাগরীয় দেশগুলোতে সেই সাফল্য ইরান পায়নি। কারণ তেহরানের উদ্দেশ্য নিয়ে ঐ দেশগুলোর মধ্যে এখনও প্রবল সন্দেহ রয়েছে। ফলে উপসাগরের ছটি দেশেই এখনও আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। বাহরাইনে রয়েছে মার্কিন নৌ-বাহিনীর পঞ্চম বহরের ঘাঁটি।
ইরানের প্রভাব বলয় প্রসারের পেছনে একসময় বড় বাধা ছিলেন সাদ্দাম হোসেন । ২০০৩ সালে আমেরিকান আগ্রাসনে তার পতনের পর ইরান রাতারাতি যে সুবিধা পেয়ে যায় তা কাজে লাগানোর চেষ্টা তারা তখন থেকেই অব্যাহত রেখেছে।
ইরাকে একাধিক শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী তৈরি এবং তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে ইরান। ইরাকি পার্লামেন্টের ভেতর ইরানের পক্ষে কথা বলার মত অনেকগুলো প্রভাবশালী কণ্ঠ রয়েছে।
এরপর সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ ইরানকে সেদেশে সামরিক উপস্থিতির সুযোগ তৈরি করে দেয়। তাছাড়া পাশের দেশ লেবাননে ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী হেযবোল্লাহ দেশটির সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তি।
ইরান ধৈর্য ধরে দীর্ঘ একটি খেলা খেলছে। তারা আমেরিকাকে ভাবতে বাধ্য করেছে যে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক অবস্থান এবং তৎপরতা আর তাদের স্বার্থের পক্ষে নয়। ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে তেহরানে অনেকেই মনে করবেন তারা সঠিক পথেই রয়েছেন এবং হাওয়া তাদের পক্ষেই বইছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৪২
আপনার মতামত জানানঃ