ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে নিষেদ্ধের কথা জানিয়েছেন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল। এতে গাজা উপত্যকার শাসক গোষ্ঠীকে নিয়ে যুক্তরাজ্যের দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাতারে চলে এসেছে।
ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গ্রুপ হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ব্রিটেন। শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেলের বরাতে এ খবর জানিয়েছে রয়টার্স।
এক বিবৃতিতে প্রীতি প্যাটেল বলেন, মারাত্মক সন্ত্রাসী তৎপরতার সক্ষমতা আছে হামাসের। এছাড়া ব্যাপক ও অত্যাধুনিক অস্ত্রাগার ছাড়াও সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ স্থাপনা আছে গোষ্ঠীটির। আর এ কারণেই হামাসকে আজ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে পদক্ষেপ নিয়েছি।
যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সন্ত্রাসবাদী আইনের অধীন সংগঠনটি নিষিদ্ধ করা হবে। এতে কেউ হামাসকে সমর্থন কিংবা তাদের পতাকা ওড়ালে আইন ভঙ্গ করা হবে। সংগঠনটির সঙ্গে যে কোনো বৈঠকও নিষিদ্ধ বলে গণ্য হবে।
শুক্রবার ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কেউ হামাসের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করলে, তাদের পতাকা উড়ালে বা সংগঠনের জন্য বৈঠকের আয়োজন করলে তা দেশটির প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন হবে। এক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবাদকে মদদ দেওয়ার অভিযোগে ১৪ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
এ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্য ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাতারে চলে আসবে। ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ গাজা-ভিত্তিক হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দিয়েছে।
যুক্তরাজ্য এখন পর্যন্ত কেবল হামাসের সামরিক শাখা ‘ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেড’ নিষিদ্ধ করেছে।
এবার হামাসকে নিষিদ্ধ করার যুক্তরাজ্যের সিদ্ধান্তের খবরকে স্বাগত জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট। এক টুইটার পোস্টে তিনি বলেন, ‘সহজ কথায় বলতে গেলে, হামাস একটি সন্ত্রাসী সংগঠন’।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ার লাপিড বলেন, ‘সন্ত্রাসী সংগঠনের কোনো বৈধ শাখা থাকে না। তাই সন্ত্রাসী সংগঠনের বিভিন্ন শাখার মধ্যে পার্থক্য করার যেকোনো প্রচেষ্টা কৃত্রিম।’ ২০০১ সালের হামাসের সামরিক শাখাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে যুক্তরাজ্য।
এনডিটিভি জানায়, গাজায় হামাসের এক কর্মকর্তা বলেছেন, যুক্তরাজ্য থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও ঘোষণা না আসা পর্যন্ত হামাস এ ব্যাপারে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাবে না।
১৯৮৭ সালে হামাস প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা। ইসরায়েলের অস্তিত্ব এবং শান্তি আলোচনার ঘোর বিরোধিতা করে আসছে এই দলটি। বরং এর পরিবর্তে দলটি ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ লড়াইয়ের জন্য সোচ্চার।
ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে সর্বসম্প্রতি বড় ধরনের সহিংসতা হয়েছে গত মে মাসে।
ওই সময় গাজায় ১১ দিনের লড়াই-সংঘাতে ফিলিস্তিনের হিসাবমতে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় মারা যায় ৬৬ শিশুসহ ২৫০ জন। আর ইসরায়েলের হিসাবমতে, ফিলিস্তিনের রকেট হামলায় ২ শিশুসহ ১৩ ইসরায়েলি নিহত হয়।
এর আগে ফিলিস্তিনের খ্যাতনামা ছয়টি মানবাধিকার সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনের তকমা দিয়ে একটি সামরিক আদেশ জারি করে ইসরায়েল। এসব সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করছে ইসরায়েলি বাহিনী। তাদের এ পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন।
ইসরায়েলের এমন নির্দেশ জারির পর ওই ৬টি সংগঠনের সদস্যদের বিরুদ্ধে ঘেরাও অভিযান পরিচালনা করতে পারবে ইসরায়েলি সেনারা। পারবে তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে। এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন ফিলিস্তিনিরা।
যেসব গ্রুপকে এই তালিকায় ফেলা হয়েছে তার মধ্যে আছে ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আল হক, আদামীর রাইট গ্রুপ, ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল-প্যালেস্টাইন, দ্য বিসান সেন্টার ফর রিসার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, দ্য ইউনিয়ন অব প্যালেস্টাইনিয়ান ওমেন্স কমিটিজ এবং দ্য ইউনিয়ন অব এগ্রিকালচারাল ওয়ার্ক কমিটিজ।
এদিকে ফিলিস্তিনি এলাকাগুলোতে পুলিশের ক্ষমতা আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে ইসরায়েল। এমনিতেই দখলদাররা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে তল্লাশি-অভিযানে পুলিশ বাহিনীকে নজিরবিহীন ক্ষমতা দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এবার তাদের নতুন উদ্যোগ কার্যকর হলে, কোনো ধরনের ওয়ারেন্ট ছাড়াই ফিলিস্তিনিদের ঘরে ঢুকে তল্লাশি চালাতে পারবে ইসরায়েলি পুলিশ।
ইসরায়েলি মিডিয়াগুলো জানিয়েছে, পুলিশ বাহিনীর ক্ষমতাবৃদ্ধির একটি বিলে অনুমোদন দিয়েছে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ইসরায়েলি পুলিশ যদি মনে করে, তারা কোনো বাড়িতে ঢুকলে গুরুতর অপরাধে জড়িত সন্দেহভাজনকে আটক অথবা এ সংক্রান্ত প্রমাণ জোগাড় করতে পারবে, তাহলে সেখানে প্রবেশে আদালতের পূর্বঅনুমতির দরকার হবে না।
মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর বিলটি ইসরায়েলি পার্লামেন্টে তোলা হবে। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন পেলে সেটি আইনে পরিণত করা হবে।
হামাসের প্রতিক্রিয়া
এদিকে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস।
এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, এ ধরনের কাজ না করে ব্রিটিশ সরকারের উচিত অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠায় নিজেদের ভূমিকার কথা স্মরণ করে লজ্জিত হওয়া।
হামাসের বিবৃতিতে ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তে দুঃখ প্রকাশ করে বলা হয়, ফিলিস্তিন সংকটের ব্যাপারে ব্রিটেন তার অতীতের ভুল নীতির পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে।
হামাসের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার লঙ্ঘনের ঐতিহাসিক ভুল সংশোধন ও ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের সংগঠনকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলে অভিহিত করেছে।
ব্রিটেনের এ ধরনের ঘোষণায় ভয় পায় না হামাস, বরং যেকোনো মূল্যে ফিলিস্তিনি জনগণের স্বার্থ রক্ষায় বদ্ধপিরকর। বিবৃতিতে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে দ্বৈত নীতি পরিহার করতে ব্রিটেন ও জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হামাস।
বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে জবাবদিহি করতে হবে : ওআইসি
ওআইসির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ১৭ নভেম্বর তারিখে পূর্ব জেরুসালেমে ছুরি হামলা চেষ্টার অভিযোগে ১৬ বছরের ওমর আবু আসাবকে গুলি করে হত্যা করেছে ইসরায়েলি পুলিশ। এছাড়া আরো বলা হয়েছে যে, ফিলিস্তিনি কারাবন্দীদের ওপর নিপীড়ন ও তাদের চিকিৎসায় অবহেলার কারণে বহু ফিলিস্তিনি মারা যাচ্ছেন। উদাহরণ স্বরূপ সংগঠনটি বলেছে, চিকিৎসায় অবহেলার কারণে সামি উমার নামের এক ফিলিস্তিনি কারাবন্দী মারা গেছেন।
ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের বিভিন্ন অপরাধের নিন্দা করে ওআইসি জোর দিয়ে বলেছে, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সহিংসতা ও আক্রমণের কারণে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আরো বাড়তে পারে।
এছাড়া ইসলামী সহযোগিতা সংস্থাটি তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ইসরায়েলকে এসব অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। ওই দু’ফিলিস্তিনি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কমিটি গঠন করে তদন্ত করার জন্য জাতিসঙ্ঘ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনকে আহ্বান জানিয়েছে ওআইসি।
এছাড়া ওআইসির পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, ইসরায়েলের কারগারে বন্দী থাকাবস্থায় অনশনরত ফিলিস্তিনিদের বাঁচাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে হস্তক্ষেপ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০২
আপনার মতামত জানানঃ