দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল এলাকাজুড়ে আমাজন বনাঞ্চল বিস্তৃত। এই বনভূমির বিশাল অংশ ব্রাজিলের মধ্যে পড়েছে এবং সেখানে বনের গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে বলে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে।
ব্রাজিলের আমাজনে গত ১৫ বছরের মধ্যে এ বছর সর্বোচ্চ পরিমাণ বন উজাড়ের ঘটনা ঘটেছে। সরকারি তথ্যের বরাত দিয়ে শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইনপে)-র একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, আমাজন বনাঞ্চলে বন উজাড়ের ঘটনা গত বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০-২১ সময়সীমায় আমাজনের বনাঞ্চলের প্রায় ১৩ হাজার ২৩৫ বর্গ কিলোমিটার (৫ হাজার ১১০ বর্গ মাইল) এলাকার বন উজাড় হয়েছে। ২০০৬ সালের পর থেকে যা সর্বোচ্চ।
এছাড়াও সরকারি তথ্যের বরাত দিয়ে বিবিসি বলছে, আমাজন বনাঞ্চলে প্রায় ৩০ লাখ প্রজাতির গাছ ও প্রাণী রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের ১০ লাখ মানুষ বসবাস করেন। ব্রাজিলের আমাজন বনাঞ্চলে গত ১৫ বছরের মধ্যে চলতি বছর সর্বোচ্চ পরিমাণ গাছ উজাড়ের ঘটনা ঘটেছে।
এর আগে চলতি মাসের শুরুতে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক কপ-২৬ সম্মেলনে প্রথম বৃহৎ কোনো চুক্তি হিসেবে বন উজাড় বন্ধের বিষয়ে একমত হন বিশ্বের শতাধিক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা। সেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার বিষয়ে একমত হন তারা। সম্মেলনে বন উজাড় বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিলও ছিল।
গ্লাসগো সম্মেলনকে ঘিরে ২০৩০ সালের মধ্যে বনভূমি নিধনের ইতি টানতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিল অন্যতম। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির প্রেসিডেন্ট বলসোনারো ২০২৮ সালের মধ্যে অবৈধভাবে বন উজাড় ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কিন্তু পরিবেশবাদি সংগঠনগুলো বলছে, বলসোনারোর আমলেই খনন কাজ আর কৃষি জমি তৈরির জন্য বননিধন বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এই প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে সন্দিহান তারা।
গ্রিনপিস আমাজন ক্যাম্পেইনের মুখপাত্র রোমুলো বাতিস্তা বলেন, বননিধন এবং আগুন লাগার ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং আদিবাসী ও স্থানীয়দের মধ্যে সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। এই প্রতিশ্রুতি আদৌ বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন করবে না।
আইএনপিইর তথ্য-উপাত্ত বলছে, আমাজনে শুধু অক্টোবরেই ১১ হাজার পাঁচশর বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ছিল ১৭ হাজার তিনশ। কিন্তু ২০১৯ সালের পর এসব ঘটনা দ্রুত বেড়েছে এবং তখন ছিল সাত হাজার নয়শটি।
২০১৯ সালে জাইর বলসোনারো ক্ষমতায় বসার পর আমাজনের ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার খোয়া গেছে এক বছরেই, যার আয়তন প্রায় লেবাননের সমান। গত দশকে এটা ছিল ৬ হাজার পাঁচশ বর্গকিলোমিটার।
ব্রাজিলের পরিবেশমন্ত্রী জোয়াকিম লেইটে বলছেন, বন উজাড়ের এই তথ্য আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে এবং এসব অপরাধ প্রতিরোধে আমাদেরকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমাজন বনাঞ্চলে বন উজাড়ের ঘটনা গত বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০-২১ সময়সীমায় আমাজনের বনাঞ্চলের প্রায় ১৩ হাজার ২৩৫ বর্গ কিলোমিটার (৫ হাজার ১১০ বর্গ মাইল) এলাকার বন উজাড় হয়েছে। ২০০৬ সালের পর থেকে যা সর্বোচ্চ।
দক্ষিণ আমেরিকার ছোট–বড় নয়টি দেশকে ঘিরে রয়েছে আমাজন অরণ্যের বিস্তার। এই দেশগুলো হলো ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল, পেরু, বলিভিয়া, কলাম্বিয়া, ইকুয়েডর, গায়ানা, সুরিনাম আর ফ্রান্স (ফ্রান্স গায়ানা)।
বিশ্বের ১২টি রেইনফরেস্টের মধ্যে আমাজন বেসিনের রেইনফরেস্ট বৃহত্তম। প্রকৃতপক্ষে এর আয়তন ছিল ২ দশমিক ১২৪ মিলিয়ন বর্গমাইল। দক্ষিণ আমেরিকার আয়তন ৬ দশমিক ৮৯০ মিলিয়ন বর্গমাইল।
পাঁচ দশক ধরে মানুষ এই অরণ্যকে সংকুচিত করে চলেছে অপরিণামদর্শিতার সঙ্গে। ৫৫ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর আগেও আমাজন অরণ্যের অস্তিত্ব ছিল বলে ভূতত্ত্ববিদদের অভিমত। এর জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকান প্লেট (আটলান্টিক ওশানে মেজর টেকটোনিক প্লেট, যার মধ্যে পুরো দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ রয়েছে এবং এটি আফ্রিকান প্লেট পর্যন্ত বিস্তৃত) এবং নাজকা প্লেটের সংঘর্ষে যখন আন্দিজ পর্বতমালার সৃষ্টি হয়।
ব্রাজিল থেকে গায়ানা পর্যন্ত এক বিরাট অঞ্চল সেই সংঘর্ষেই জেগে ওঠে। মাঝখানে বয়ে যায় আমাজন নদীসহ অসংখ্য নদনদী। এখানে প্রথম প্রাণের লীলা চাঞ্চল্য জেগে ওঠে সবুজ ঘাসের আস্তরণে। তারপর বৃক্ষরাজি, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি আর মানুষের আশ্রয়দাতা হয়ে ওঠে আমাজন রেইনফরেস্ট।
জীবের জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন যতটা জরুরি, পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীর সব রেইনফরেস্ট। রেইনফরেস্ট পৃথিবীর ফুসফুস। এরা কেবল জল, বায়ু, খাদ্য আর ওষুধ উৎপাদনের উৎস নয়; হাজারো প্রাণিপ্রজাতির আশ্রয়দাতা। বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস শুষে নেওয়ার শক্তিশালী শোষক।
একুশ শতকের পরিবর্তিত জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব রুখে দিতে সে কারণেই কিংবদন্তি ভূমিকা রয়েছে রেইনফরেস্টগুলোর। এ জন্যই আমাজন অরণ্যের ধ্বংস নিয়ে সারা পৃথিবী উদ্বিগ্ন আজ।
বিশ শতক থেকে যেভাবে সারা বিশ্বে অরণ্যভূমি বিনষ্ট করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, অতীতে সেভাবে কোনো দিনও হয়নি। বরং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা বজায় রেখে হাজার হাজার বছর ধরে অরণ্যবাসী মানুষ ও বন্য প্রাণী বসবাস করে এসেছে অরণ্যের অভ্যন্তরে। এরপর জনসংখ্যা যত বেড়েছে, জড়বিজ্ঞানের প্রবল প্রতাপ যত বেশি আকাশচুম্বী হয়েছে, ততই অরণ্য সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।
১৯৭০ সালে আমাজনের বনভূমি প্রথম ধাপে উজাড় হওয়া শুরু হয় যখন ব্রাজিলের সামরিক সরকার খেয়াল করে এই বনের ভেতর লুকিয়ে আছে বিশাল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এ বন থেকে ব্রাজিলের তৎকালীন সরকার অর্থনৈতিক উন্নতির অপার সম্ভাবনা দেখছিল। কিন্তু দুর্গম বনভূমির জন্য এগুলো সংগ্রহ করা অসম্ভব ছিল। তাই ব্রাজিলের সরকার আমাজনের ভেতর দিয়ে ৩,২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ট্রান্স-আমাজনিয়ান হাইওয়ে নির্মাণ করা শুরু করে যা আমাজনের গহীন অরণ্যে মানুষের প্রতিনিয়ত চলাচলের সূচনা করে।
ওই সময়ে ব্রাজিলের বেশিরভাগ মানুষ দক্ষিণ-পূর্বে রিও-ডি-জেনিরো, সাও পাওলোর মত শহরে থাকতো। ব্রাজিলের সরকার জমি চাষাবাদ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে জনগণকে আমাজনে স্থানান্তর করতে চেয়েছিল। এই লক্ষ্যে ব্রাজিলের সরকার এই হাইওয়ের পাশে বিনামূল্যে জমির বিতরণ করা শুরু করেছিল, এরই সাথে সাথে জনগণকে প্রণোদনা দেওয়াও শুরু হয়েছিল এখানে বসতি স্থাপনের জন্য। হাইওয়ে নির্মাণের সাথে সাথে তার চারপাশের বন উজাড়ের হারও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এসকল বেশিরভাগ জমিই গরুর খামার করার জন্য চারণভূমিতে রুপান্তরিত করা হয়। লাভবান ব্যবসা হওয়ায় চারণভূমি বাড়ানোর জন্য আমাজনের আরো গহীনে বনভূমি উজাড় করা শুরু হয়।
জড়বিজ্ঞান সভ্যতায় বছরের পর বছর ধরে সীমাহীন নগরায়ণের কারণে, শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজে, আসবাবপত্র কিংবা জ্বালানির ব্যবহারে, কৃষিজমির অনুসন্ধানে এবং আরও হাজার রকমের নিষ্ঠুর অভিপ্রায় নিয়ে বিশাল বিস্তীর্ণ বনভূমিকে মানুষ নিঃশেষিত করেছে অপূরণীয় ক্ষতিতে।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এখন স্পষ্ট। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে নিয়মিত ভাবে দাবদাহ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। একইসঙ্গে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও।
এছাড়া বনের গাছ কেটে ফেললে সেটিও জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। কারণ গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং বিপুল পরিমাণে বন উজাড় হলে বায়ুতে ক্ষতিকর এই গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর তাই আমাজনে বন উজাড়ের এই ঘটনা পুরো বিশ্বের জন্যই চ্যালেঞ্জ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, যত বেশি বনাঞ্চল ধ্বংস হবে, তত বেশি মারণ ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ, বনভূমি হল মানুষ ও ভাইরাসের মাঝে ঢাল। এমনটা আগেই জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। বন্য প্রাণীর শরীরে থাকা অজানা ভাইরাস ছড়ানো রোধ করতে হলে বনাঞ্চল ধ্বংস আটকাতে হবে সবার আগে।
তারা বলছেন, করোনার পরবর্তী ভাইরাস ছড়াতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্য আমাজন থেকে। কারণ সেখানে নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। আর সেটা সব থেকে চিন্তার বিষয় এখন।
সারা বিশ্বের ২০ শতাংশ অক্সিজেনের জোগান দেয় আমাজন বনভূমি। তার থেকেও বড় কথা, এই বনভূমিতে বহু নাম না জানা প্রাণীও রয়েছে। তাদের শরীরে রয়েছে অজানা প্রাণঘাতী ভাইরাস। সেই ভাইরাস একবার মানুষের মধ্যে ছড়াতে শুরু করলে বিপদ।
ব্রাজিলের পরিবেশ বিজ্ঞানী ডেভিড লাপোলা জানিয়েছেন, বনাঞ্চলে নগরায়ন করলে বিভিন্ন প্রাণী থেকে ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়ানো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমাজনের গভীর অরণ্যে বহু চেনা-অচেনা ভাইরাস রয়েছে। মানুষ বনাঞ্চল ধ্বংস করে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলে সেই ভাইরাসে সংক্রমিত হবে। আর আমাজন যেভাবে ধংস করা হচ্ছে তাতে এর পর সেখান থেকেই নতুন কোনও ভাইরাস ছড়াতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৯
আপনার মতামত জানানঃ