করোনা মহামারিতে বিশ্বে বিপর্যস্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত একটি। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর পাশাপাশি লকডাউনের কারণে নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে দেশটি। এরইমধ্যে বায়ুদূষণের ফলে দৃষ্টিসীমা কমে আসা, দূষণে শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানের বায়ুদূষণ আরো মারাত্মক রূপ নিয়েছে। জ্বালানি হিসেবে নিম্নমানের ডিজেল ব্যবহার, শস্য পোড়নোর ধোঁয়াসহ শীতের ঠাণ্ডা তাপমাত্রায় স্থির মেঘের ধোঁয়াশার কারণে দেশটির বায়ুদূষণ পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তকমা পেয়েছে। ১৭ নভেম্বর এয়ার কোয়ালিটি অ্যান্ড পলিউশন সিটি র্যাংকিংয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দূষিত শহরের তালিকার প্রথম স্থানে রয়েছে লাহোর। এদিকে তীব্র ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন শহরবাসী এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার প্রথম ১০টি শহরের মধ্যে এর পর রয়েছে চীনের উহান, ভারতের দিল্লি, চীনের বেইজিং, ভারতের কলকাতা, পাকিস্তানের করাচি, কুয়েতের কুয়েত সিটি, পোল্যান্ডের ওকলাও, ক্রোয়েশিয়ার জাগরেব এবং ভারতের মুম্বাই। দূষণের দিক দিয়ে ১৫তম শহর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।
দূষণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় লাহোরের বাতাসে তীব্র ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। দূষণের মাত্রা দাঁড়িয়েছে ৩৪৮-এ, যা ৩০০ ছুঁলেই বিপজ্জনক হিসেবে গণ্য করা হয়। এ অবস্থায় দমবন্ধ দিন কাটাচ্ছেন লাহোরের বাসিন্দারা। অনেক শিশুই শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে।
লাহোর পাকিস্তানের অন্যতম ব্যস্ত নগরী। লোকসংখ্যা এক কোটির বেশি। ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি এই শহরটি গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে।
এরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও এ নিয়ে পাকিস্তান সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ করেছেন লাহোরের বাসিন্দারা।
এ বিষয়ে ইকরাম আহমেদ নামের এক দোকানী বলেন, আমরা গরীব মানুষ। ডাক্তারের পেছনে খরচ করার মতো আমাদের অর্থ নেই। আমরা শুধু তাদের কাছে আবেদন করতে পারি যেন বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নইলে আমরা মরে যাব।
মোহাম্মদ সাঈদ নামের একজন শ্রমিক বলেন, ‘শিশুরা কষ্ট পাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তারা নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। নানারকম সমস্যায় আক্রান্ত তারা।
তিনি বলেন, এখানে ছোট বড় অনেক শিল্পকারখানা রয়েছে। হয় এগুলো এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে, নইলে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এগুলো চালাতে হবে।
সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার প্রথম ১০টি শহরের মধ্যে এর পর রয়েছে চীনের উহান, ভারতের দিল্লি, চীনের বেইজিং, ভারতের কলকাতা, পাকিস্তানের করাচি, কুয়েতের কুয়েত সিটি, পোল্যান্ডের ওকলাও, ক্রোয়েশিয়ার জাগরেব এবং ভারতের মুম্বাই। দূষণের দিক দিয়ে ১৫তম শহর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।
এদিকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে দিনকে দিন চরম অবনতির দিকে যাচ্ছে বাতাসের মান। বায়ুদূষণে জেরবার এ শহর ও আশপাশের এলাকাগুলোতে পরিস্থিতি সামাল দিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে স্কুল-কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ২১ নভেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে সব ধরনের নির্মাণকাজ। একই সময় পর্যন্ত সরকারি অফিসগুলোতে ৫০ শতাংশ কর্মচারীর বাসা থেকে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দিল্লির দূষণের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে করণীয় নিয়ে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা চলছে কয়েকদিন ধরেই। দূষণের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে দিল্লি এবং আশপাশের শহরের স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করতে হলো। মঙ্গলবার গভীর রাতে জানিয়েছে কমিশন ফর এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট (সিএকিউএম)। তবে কোভিডের সময় অনলাইনে যেভাবে ক্লাস চলতো সেভাবেই ফেরার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে বলা হয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার রাতে দিল্লি ও আশপাশের অঞ্চলগুলোর বায়ুমান ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত কমিশন-সিএকিউএম এসব নির্দেশনা জারি করে। নির্দেশনা অনুযায়ী, জরুরি পণ্য সরবরাহকারী পরিবহন ছাড়া কোনো ট্রাক ২১ নভেম্বর পর্যন্ত দিল্লিতে প্রবেশের অনুমতি পাবে না। পরিস্থিতি বুঝে বাড়ানো হতে পারে এ সময়সীমাও।
সিএকিউএমের আওতায় রয়েছে দিল্লি ছাড়াও উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও রাজস্থান। এসব রাজ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ৫০ শতাংশ কর্মীকে বাসা থেকে কাজ করার জন্য জোর দেওয়া হয়েছে সিএকিউএমের নির্দেশনায়।
২১ নভেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে নির্মাণকাজও। তবে ছাড় পাবে রেল, মেট্রো, বিমানবন্দর, বাস টার্মিনাল এবং সামরিক প্রকল্পের নির্মাণ। দূষণ কমাতে দিল্লির ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যের ছয়টি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সিএকিউএমের নির্দেশনা অনুযায়ী, দূষণ নিয়ন্ত্রণে দিনে তিনবার পানি ছিটানোসহ নানা ব্যবস্থা নিতে হবে। রাস্তার ওপর নির্মাণ সরঞ্জাম রাখলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে। আবর্জনা রাখলেও মিলবে একই ধরনের শাস্তি। জরুরি কারণ ছাড়া চালু করা যাবে না ডিজেলচালিত জেনারেটর।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগের পরামর্শের জেরে সিএকিউএম এসব নির্দেশনা জারি করেছে। আবহাওয়া বিভাগের হিসাব–নিকাশ বলছে, আগামী কয়েক দিন দিল্লি অঞ্চলের বাতাসের মান খারাপ থাকতে পারে। গড়াতে পারে মারাত্মক পর্যায়েও। তবে ২১ নভেম্বরের পর পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গতকাল বায়ুমান সূচকে দিল্লির স্কোর ছিল ৫০০-এর মধ্যে ৪০৩। এর অর্থ বাতাসের দূষণের অবস্থা মারাত্মক।
প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, শিল্প কলকারখানাগুলি যাতে আর্থিক চাপের মুখে না পড়ে তাই পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত আইনকানুনকে উপেক্ষা করা হয়৷ বেশির ভাগ কলকারখানাই ইউরোপীয় মানসম্মত নয়৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাতাসের গুণগত মান রক্ষা করার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে৷ যেমন বলা হয়েছে, কলকারখানাগুলিতে সূক্ষ্ম ধুলিকণা প্রতিরোধী ফিল্টার লাগাতে হবে৷ তাপ উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে কয়লার পরিবর্তে গ্যাসের ব্যবহার করতে হবে৷ গাড়িতে ক্যাটালিটিক কনভার্টার ব্যবহার করতে হবে৷
এক্ষেত্রে আর্থিক সুযোগ সুবিধা মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে৷ যেমন পরিবেশ দূষণের জন্য বিশেষ করের প্রবর্তন করা যেতে পারে৷ যারা বায়ু দূষণকারী মেশিন ও কারিগরি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন, তাদের ওপর এই কর আরোপ করা হলে বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে দায়িত্ববোধ জেগে উঠতে পারে৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৪
আপনার মতামত জানানঃ