১৫৭ বছর পুরনো ঔপনিবেশিক আমলের একটি আইনে সমকামিতা অপরাধ হিসেবে গণ্য ছিল ভারতে। ব্রিটিশ জামানার এই বিতর্কিত আইনটির সুবাদে ‘অপ্রাকৃতিক যৌনতা’র অপরাধে ভারতে কোনও ব্যক্তির ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারতো। এরপর ২০১৮ সালে এই আইন বাতিল করা হয়। তবে এখনও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি দেশটিতে প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ ভারতে একদিকে দিল্লির হাই কোর্টের বিচারপতি পদে অভিজ্ঞ আইনজীবী সৌরভ কীর্পালের পদোন্নতির সুপারিশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট; যিনি কিনা সমকামী, অন্যদিকে ভারতীয় ক্রিকেট তারকা ও জাতীয় দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলির ‘ওয়ান৮ কমিউন’ নামের রেস্তোরাঁয় সমকামীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
সমকামিতা এবং ভারত
সমকামিতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বর্ণনা করা ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা দেড়শ বছরেরও বেশি পুরোনো। ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সরকার এই ধারার প্রবর্তন করেছিল। সেই ধারাকে প্রথম চ্যালেঞ্জ জানায় এইডস ভেদভাও বিরোধী আন্দোলন (এবিভিএ) নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। দিল্লির তিহার জেলে পুরুষ বন্দীদের মধ্যে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কনডম বিলির অনুমতি চেয়েছিল। কিন্তু তিহার জেলের তৎকালীন সুপারিনটেনডেন্ট কিরণ বেদি সেই অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। সেটা ১৯৯৪ সাল।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নাজ ফাউন্ডেশন প্রথম এই আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করে। সেটা ২০০১ সাল। ২০০৪ সালে দিল্লি হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ মামলাটি খারিজ করে দেন। রিভিউ আবেদন গ্রহণেও অগ্রাহ্য করেন। পরবর্তীকালে দেশজোড়া সমকামী আন্দোলনের জেরে হাইকোর্টকে সুপ্রিম কোর্ট সেই পুরোনো মামলা শোনার নির্দেশ দেন। ২০০৯ সালে দিল্লি হাইকোর্ট জানান, সম্মতির ভিত্তিতে দুই প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে যৌন সম্পর্ক অপরাধ নয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে একাধিক ব্যক্তি ও সংগঠন সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানান।
২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায় খারিজ করে জানান, ৩৭৭ ধারার সাংবিধানিক বৈধতা রয়েছে। ওই ধারা বাতিল করে সমকামিতাকে বৈধতা দিতে গেলে সংসদে আইন পাস করাতে হবে। ২০১৪ সালে নাজ ফাউন্ডেশন, কেন্দ্রীয় সরকার এবং অন্যদের রিভিউ আবেদন বাতিল হয়। দুই বছর পর আবেদনটি বিবেচনার জন্য পাঠানো হয় পাঁচ বিচারপতির এজলাসে।
এই সময়ের মধ্যে ঘটে যায় দুই যুগান্তকারী রায়। ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের মান্যতা দেন। তাঁদের বিরুদ্ধে বৈষম্য সৃষ্টির বিরুদ্ধে রায় দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জানান, এসব মানুষ সব ধরনের অধিকার পাওয়ার যোগ্য। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের নয় বিচারপতির বেঞ্চ রায় দিয়ে বলেন, ব্যক্তিপরিসর রক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার।
ব্যক্তিপরিসর রক্ষার অধিকার মৌলিক, এই রায় প্রত্যক্ষভাবে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার পরিপন্থী। কেন্দ্রীয় সরকারও ৩৭৭ ধারা নিয়ে সিদ্ধান্তের ভার সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনার ওপরেই ছেড়ে দেয়। অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতভাবে জানিয়ে দেয়, সমকামিতা আর অপরাধযোগ্য নয়।
দিল্লির হাই কোর্টে সমকামী বিচারপতি
সম্প্রতি ভারতের রাজধানী দিল্লির হাই কোর্টের বিচারপতি পদে অভিজ্ঞ আইনজীবী সৌরভ কীর্পালের পদোন্নতির সুপারিশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের কলেজিয়ামের এই সিদ্ধান্তকে ‘ঐতিহাসিক’ বলছে আইনজীবী মহল।
ভারতের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে এই প্রথম একজন সমকামী আইনজীবীকে বিচারপতি পদে বসানোর সুপারিশ করলো সর্বোচ্চ আদালত। শুধু তাই নয়, দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতি পদে কীর্পালকে নিয়োগ করা হলে তিনিই হবেন ভারতের প্রথম সমকামী বিচারপতি।
২০১৭ সালের অক্টোবরে দিল্লি হাই কোর্টের কলেজিয়াম প্রথম কীর্পালের পদোন্নতির সুপারিশ করেছিল। তারপর আরও বেশ কয়েক বার তার নাম উঠে আসে। কিন্তু প্রত্যেক বারই বিলম্বিত হয়েছে কীর্পালের পদোন্নতির প্রক্রিয়া।
চলতি বছরের মার্চে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এসএ বোবদে দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতি পদে কীর্পালের পদোন্নতি নিয়ে কেন্দ্রের অবস্থানও জানতে চেয়েছিলেন।
তারপরই গত ১১ নভেম্বর শীর্ষ আদালতের কলেজিয়ামের বৈঠকে কীর্পালের নাম সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, হাই কোর্টের প্রথম সমকামী বিচারপতি হতে চলেছেন সৌরভ কীর্পাল। তাকে অনেক শুভেচ্ছা। শেষ পর্যন্ত যৌন বিষয়ক বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে সব ধরনের মানুষদের নিয়ে তৈরি হচ্ছে আমাদের বিচার ব্যবস্থা।
দিল্লির স্টিফেন কলেজ থেকে পাশ করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন কীর্পাল। স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন কেজব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তিনি। ২০১৮ সালে অনুচ্ছেদ ৩৭৭ বাতিলের মামলায় মামলাকারীদের আইনজীবী ছিলেন কীর্পাল।
রেস্তোরাঁয় সমকামীরা নিষিদ্ধ
ভারতীয় ক্রিকেট তারকা ও জাতীয় দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলির ‘ওয়ান৮ কমিউন’ নামের রেস্তোরাঁয় সমকামীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। খবর ইন্ডিয়া টুডে ও আনন্দবাজার পত্রিকার।
এ নিয়ে সমকামীদের সমর্থক সংগঠন ‘ইয়েস উই এক্সজিস্ট’ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। ওই সংগঠনটি তাদের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে লেখে, কোহলির রেস্তোরাঁয় সমকামী যুগল ও নারীদের ঢুকতে দেওয়া হয় না।
কৌশাল নামের এক সমকামী টুইটবার্তায় বলেন, রেস্তোরাঁয় এমন নিষেধাজ্ঞা নতুন ইন্ডিয়ার জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। কোহলির এমন লিঙ্গ বৈষম্যমূলক আচরণে সমকামীরা ব্যথিত হয়েছে। আমরা আশা করি আমাদের মাঝে ভুলবোঝাবুঝি তিনি দূর করবেন।
এ বিষয়ে রেস্তোরাঁর কর্মী অমিত জোশী বলেন, ‘কোনো পুরুষ একা এলে তাকে আমরা ঢুকতে দিই না। নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই এ নিয়ম চালু করা হয়েছে। যদি ছেলেমেয়েদের দল আসে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। তবে লিঙ্গের ভিত্তিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই এখানে।’
রেস্তোরাঁটির দিল্লি শাখার কর্মী নীহারিকা কুরার জানান, ‘তাদের রেস্তোরাঁয় ছেলেরা ঢুকতেই পারে। আমরা কোনো অতিথিকে না বলতে পারি না। কিন্তু যখন রেস্তোরাঁ ভর্তি থাকে, শুধু তখনই একা আসা পুরুষদের ফিরিয়ে দিতে হয়। কিংবা কেউ ছোট প্যান্ট পরে এলে তাকেও ঢুকতে দেওয়া হয় না।’
এসডব্লিউ/এসএস/২০৪৫
আপনার মতামত জানানঃ