‘নির্বাচন কোনো ইভেন্ট নয়। এটি একটি প্রসেস। জাতীয় নির্বাচন হতে এখনও দুই বছর বাকি। বাংলাদেশ ভোট দেওয়ার চর্চা অব্যাহত রাখবে। ইইউ বাংলাদেশের ভোট ও নির্বাচনের ওপর পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে’- বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এমনই মতামত ব্যক্ত করেছেন ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি।
গতকাল সোমবার ঢাকায় কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সংগঠন ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্ট অব বাংলাদেশ ডিক্যাব-এর আলোচনা অনুষ্ঠানে হোয়াইটলি এমন মতামত দেন।
এ সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিটি স্টেকহোল্ডারের এখানকার নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। কারণ নির্বাচনের সঙ্গে দেশের সার্বিক অগ্রগতি সম্পৃক্ত। এতে জনমত প্রতিফলিত হয়। তাই আমরা স্টেকহোল্ডার বা বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদাররা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করি, এটা কোনো হস্তক্ষেপ নয়। স্টেকহোল্ডার বা অংশীদার হিসেবে দিনশেষে আমরা দেখতে চাই, প্রতিটি ভোটার যেন এটা মনে করে যে, তারা যে ভোট দিয়েছেন তা গণনায় এসেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক বাণিজ্য, রাজনীতি, উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে বলে উল্লেখ করেন ইইউ দূত।
এ সময় চার্লস হোয়াইটলি আরো বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইইউ কিছু নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তিনি বলেন, মিয়ানমার নিষেধাজ্ঞা দিলেও সেখানে মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে ইইউ। মিয়ানমারে আমরা যদি কাজ না করি তবে অন্য কেউ এসে সে জায়গা দখল করবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে ইইউ খোলামেলা কথা বলে যাচ্ছে।’ বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রসঙ্গে চার্লস হোয়াইটলি বলেন, ‘আমি ১২ বছর আগে বাংলাদেশে এসেছিলাম। তখন থেকে এখন বর্তমানে অবকাঠামো দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে।’
তিনি বলেন, ‘মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও এদেশের সুশীল সমাজের সঙ্গে ইইউ সম্পর্ক রেখে চলেছে। আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার নিয়ে যেসব প্রতিবেদন হয় সেগুলোকে আমরা স্বাগত জানাই।’
সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক আক্রমণ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘ইইউ এ বিষয়ে দৃষ্টি রেখে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো এ ঘটনার (সাম্প্রদায়িক আক্রমণ) পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়ভাবে বলেছেন, সংখ্যালঘু জনগণকে অবশ্যই নিরাপত্তা দিতে হবে।’
নির্বাচন নিয়ে হতাশা
নির্বাচন নিয়ে ইইউ রাষ্ট্রদূত মতামত প্রকাশের আগের দিন ঢাকায় জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন।
চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অব্যাহত সহিংসতা, প্রাণহানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে কমিশনার বলেন, দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা এখন আইসিইউতে। একইসঙ্গে গণতন্ত্র লাইফ সাপোর্টে।
প্রসঙ্গত, সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষের পর্যায়ে। পাঁচ বছরের পুরো মেয়াদে কমিশনার মাহবুব তালুকদার নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে নিজের অবস্থান জানিয়ে আসছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য তিন কমিশনার অবশ্য কখনই মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেননি।
গত রোববার নির্বাচন কমিশনে নিজ কার্যালয়ে এক লিখিত বক্তব্যে কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, দেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণু মনোভাব গণতন্ত্রকে অন্তিম অবস্থায় নিয়ে গেছে। খেলায় যেমন পক্ষ-বিপক্ষের প্রয়োজন হয়, তেমনি একপক্ষীয় কোনো গণতন্ত্র হয় না।
তিনি বলেন, বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো মূল্যে গণতন্ত্রকে আমরা লাইফ সাপোর্ট থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চাই। এজন্য দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই সংকট নিরসনে সকল দলের সমঝোতা অপরিহার্য।
মাহবুব তালুকদারের এই বক্তব্য দেয়ার পরের দিন নির্বাচন কমিশনের তরফে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাসহ অন্য দুই কমিশনার সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। নির্বাচন কমিশনের ওই সংবাদ সম্মেলনে কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে দেখা যায়নি।
এ সময় আগের দিনে দেয়া মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যের বিষয়ে সিইসি’র প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলেন উপস্থিত সাংবাদিকরা। জবাবে সিইসি সরাসরি কোনো উত্তর দিতে চাননি। তিনি বলেন, মাহবুব তালুকদার সাহেব এখানে উপস্থিত নেই তাই তার বক্তব্যের জবাব দেয়া ঠিক হবে না। তবে তিনি যা বলেছেন সেটা অশোভনীয়। তিনি নিয়মিতই এমনটি করে থাকেন।
সংবাদ সম্মেলনে থাকা অন্য নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাহাদাত হোসাইন এ বিষয়ে বলেন, তিনি বাইরে কিছু বিষয়ে ভিন্নমত করে থাকলেও নির্বাচন কমিশনের প্রায় সব সিদ্ধান্তে অন্য কমিশনারদের মতোই সায় দিয়ে থাকেন।
উল্লেখ করা যায় যে, ইতিমধ্যে প্রথম ধাপে ২১শে জুন ও ২০শে সেপ্টেম্বর ৩৬৯টি ইউনিয়ন পরিষদে এবং ১১ই নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ৮৩৩টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে।
দুই ধাপের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রায় কাছাকাছি সংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। এছাড়া প্রথম দুই ধাপের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ২৫৩ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোটের আগেই বিজয়ী হয়েছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১২১০
আপনার মতামত জানানঃ