করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি ক্রমে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। দেশি-বিদেশি বাণিজ্য সচল হচ্ছে। এই স্বাভাবিকতার সময়ে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। থমকে থাকা বাজার যেন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। করোনায় বিধ্বস্ত নিম্ন-আয়ের মানুষের নিকট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি যেন ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’ হয়ে উঠেছে।
পেঁয়াজ ও চালসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছেই। সাধারণ মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বোঝা। জীবন ধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি আর লবণসহ সবকিছুই আগের তুলনায় দাম কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে চাকরিজীবী আর খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অতিরিক্ত মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের জন্যই সাধারণ মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে সাধারণ মানুষের ধারণা।
সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, রাজধানীর মগবাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পাঁচ লিটার ভোজ্যতেলের কন্টেইনার বিক্রি হচ্ছে ৭৬০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ৭১০ টাকায়। এছাড়া ২ কেজির প্যাকেট আটার দাম ৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ৭৫ টাকা, প্যাকেটজাত চিনিও কেজি প্রতি ৫ টাকা বেড়ে ৭৫ টাকা ও ছোট দানার মসুর ডালের দাম ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ১২০ টাকা।
বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন গত সেপ্টেম্বরে চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ৭৫ টাকা নির্ধারণ করলেও তা বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ১১০ টাকায়।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়াও আমিষের সবচেয়ে সহজলভ্য উৎস মুরগি ও মুরগির ডিমের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এক সপ্তাহ আগে ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৭০ টাকা থাকলেও বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা। সেপ্টেম্বরেও ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ৫ টাকা বেড়ে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা হয়েছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এক ক্রেতা মোঃ খোরশেদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আমি প্রতি কেজি গাজর কিনেছি ১০০ টাকায়। নয় দিন আগে যে কুমড়া ছিল ৪০ টাকা, তা এখন ৭০ টাকা। এর বাইরে খোলা ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে ১৫২ টাকায়, যা দুই মাস আগেও ছিল ৭০ টাকা।
তিনি আরো বলেন, আমার ১০ সদস্যের সংসার চালাতে ২৫ হাজার টাকা প্রয়োজন কিন্তু বর্তমানে আমার খরচ হচ্ছে ৩৫ হাজার টাকা। আমার বেতন বাড়েনি, তাই সংসার চালানোর জন্য টাকা ধার করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।
শুক্রবার ঢাকার কাঁঠালবাগান, কারওয়ান বাজার, নয়াটোলা বউবাজারে প্রতি কেজি শিম ৮০ টাকায়, কাঁচা মরিচ ১০০ টাকায়, লম্বা বেগুন ৬০ টাকায়, গোল বেগুন ৭০ টাকায়, টমেটো ১৪০ টাকায়, ফুলকপি ৪০ থেকে ৫০ টাকায় ও আলু কেজি প্রতি বিক্রি হয়েছে ২৫ টাকায়।
রাজধানীসহ সারাদেশে ফের বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। সপ্তাহ ব্যবধানে কেজিতে ৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর কাওরান বাজার, নয়াবাজার, সিরপুর ও রামপুরা বাজারে পেঁয়াজের পাশাপাশি সপ্তাহ ব্যবধানে ভোজ্যতেল, আলু, হলুদ, মরিচ, আদা ও ময়দার দাম বেড়েছে।
বিক্রেতারা জানান, সাত দিন আগে খুচরা বাজারে পেঁয়াজ ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে, এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায়।
মালিবাগ থেকে একটু সস্তায় কাওরান বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা আশরাফ তালুকদার বলেন, ফের পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করেছে। কিছুদিন পরপর এ পণ্যটির দাম নিয়ে বিক্রেতারা কারসাজি করে।
পেঁয়াজ আমদানিকারক সংকর চন্দ্র ঘোষ বলেন, বাজারে দেশি পেঁয়াজ শেষের দিকে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আসায় সংকট নেই। কিন্তু চিন্তা বাড়াচ্ছে পরিবহণ খরচ। পরিবহণ ভাড়া বাড়লে স্বাভাবিক ভাবে পণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়ে। কারণ বন্দর থেকে প্রতি ট্রাক পণ্য ঢাকায় আনতে খরচ হতো প্রায় ৩০ হাজার টাকা, যা এখন ৩৮-৪০ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। প্রতি গাড়িতে ৮-১০ হাজার টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে।
আমদানি করা শুকনা মরিচ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা, যা সাত দিন আগে ছিল ২৮০ টাকা। আমদানি করা হলুদ প্রতি কেজি মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৯০ টাকা, যা আগে ছিল ১৫০-১৮০। প্রতি কেজি দেশি নতুন আদা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা, যা সাত দিন আগে ছিল ১২০ টাকা। আগে আলু ২৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও এখন দাম বেড়ে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
করোনার আতঙ্কের মধ্যে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়া মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। করোনার কারণে আজ অনেকেরই চাকরি নেই, অনেকের ব্যবসা বন্ধ। কেউ বেকার ও নিঃস্ব হয়ে অসহায়ের মতো দিন কাটাচ্ছে। কেউ আবার তার ভালো চাকরিটি হারিয়ে রাস্তায় নেমে গেছে। দিনমজুর হয়ে কাজ করতেও অনেকে বাধ্য হচ্ছে শুধু পেটের তাগিদে; পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটুখানি খেয়ে-পরে বাঁচার আশায়। অবশ্য এ কষ্ট, এ যন্ত্রণা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সমাজের মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন স্তরের মানুষদের জীবনযাপনের ওপরে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। গত এক দশকে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাজারে যথেষ্ট অর্থের সরবরাহ ছিল। ফলে একজন রিকশাচালক বা দিনমজুর ৫০০ টাকার ওপরে আয় করেন এবং সেই আয় দিয়ে সংসার খুব ভালোভাবে অতিবাহিত করছেন। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিশেষ করে চাল, ডাল, তেল ও চিনিসহ যেসব পণ্য প্রতিদিন মানুষের প্রয়োজন হয়, সেই পণ্যের দাম বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের বিপদ বাড়ে। এ কথা ঠিক যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কিছুটা বেড়েছে। ফলে, তেলের দাম বাড়ার কারণ থাকলেও অন্যান্য পণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ আসলে অজানা। এই অবস্থা সৃষ্টির মূল কারণ হলো বাজার ব্যবস্থা মনিটরিংয়ের অভাব।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিত্যপণ্যের বাজরদর নিয়ন্ত্রণে সর্বপ্রথম দরকার অসাধু বাণিজ্য সিন্ডিকেট শনাক্ত করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা। এ ক্ষেত্রে দোষীদের কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। একই সাথে যেসব কৃষিপণ্যের ঘাটতি রয়েছে, সেগুলোর অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কমাতে বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি নিতে হবে। কৃষিমূল্য কমিশন গঠনের মাধ্যমে সারা বছর বাজারে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ ও তদারকি করাও জরুরি হয়ে পড়েছে।
এদিকে ডিজেল-কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং গণপরিবহনের বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে গণসংহতি আন্দোলন। শুক্রবার (১২ নভেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এ কর্মসূচি পালন করে সংগঠনটি।
আন্দোলনে বক্তারা বলেন, ঘরে বসে, বাসে উঠে, বাজারে গিয়ে মানুষ টের পাচ্ছে জীবনযাপনের দাম অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আজ বাংলাদেশে এমন একটি সরকার ক্ষমতায়, যারা তথাকথিত উন্নয়নের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে লুটপাট করছে। সেই টাকা যোগান দেওয়ার জন্য মানুষের পকেট কাটছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ আমরা দেখতে পেলাম ডিজেল-কেরোসিনের দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে।
তারা বলেন, লুটের টাকা যোগান দেওয়াই এ সরকারের প্রধান কাজে পরিণত হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, করোনার সময় মানুষের কাজ নাই, নতুন নতুন বিনিয়োগ নাই, সরকারের এ নিয়ে সামান্য চিন্তা নাই। তার উপর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে মানুষের ওপর স্টিমরোলার চালাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার এসব চালাতে পারছে কারণ জনগণকে তারা তোয়াক্কা করে না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে জনগণকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্ষমতায় টিকে আছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের একমাত্র বাঁচার পথ জনগণের রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা। এ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটিয়ে একটি মানবিক মর্যাদার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
এদিকে জ্বালানি তেল-দ্রব্যমূল্য-গাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি-দুর্নীতি বন্ধের দাবিতে প্রতিকী কফিন মিছিল ও সমাবেশ করেছে এনডিবি। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ১২ নভেম্বর বেলা ১১ টায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এই প্রতিকী কফিন মিছিল ও সমাবেশ।
এসময় বক্তারা বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ধ্বসের মুখে জনগনের পক্ষে না থেকে ভোগান্তি-দূর্ভোগ বাড়ানোর জন্য নির্মম সিদ্ধান্ত গাড়ি ভাড়া-জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়া আমজনতার জন্য শাখের করাত। তাই চাই দ্রুত দ্রব্যমূল্য-গাড়ি ভাড়া-জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সরকার অবস্থান নেবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনার আতঙ্কের মধ্যে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়া মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। করোনার কারণে আজ অনেকেরই চাকরি নেই, অনেকের ব্যবসা বন্ধ। কেউ বেকার ও নিঃস্ব হয়ে অসহায়ের মতো দিন কাটাচ্ছে। কেউ আবার তার ভালো চাকরিটি হারিয়ে রাস্তায় নেমে গেছে। দিনমজুর হয়ে কাজ করতেও অনেকে বাধ্য হচ্ছে শুধু পেটের তাগিদে; পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটুখানি খেয়ে-পরে বাঁচার আশায়। অবশ্য এ কষ্ট, এ যন্ত্রণা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। হয়তো যারা অকারণে খেয়াল-খুশিমতো এভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছেন, তারা বুঝতেও চান না সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা। সবার মধ্যেই যেন আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার স্বপ্ন বিরাজ করে সারাক্ষণ। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে এমন অবস্থা তো মেনে নেওয়া যায় না। দ্রব্যমূল্যের মনগড়া বৃদ্ধি অবশ্যই আমাদের ঠেকাতে হবে, কঠিন আইনের মাধ্যমে অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে এ নোংরা খেলা।
তারা বলেন, মহামারি করোনা এরই মধ্যে আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, আমাদের অনেককে নিঃস্ব করে দিয়েছে। কমবেশি সবার মধ্যেই পড়েছে এর নেগেটিভ প্রভাব। অনেকে সবকিছু হারিয়ে অর্থকষ্টে দিনযাপন করছে। অন্তত সাধারণ জনগণের কথা ভেবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলোর যেন ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করা হয় এবং তা যেন সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সহনশীল মাত্রায় মূল্য নির্ধারণের জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণকারীদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ