পুলিশ জনগণের বন্ধু। পুলিশ জনগণের জানমালের রক্ষাকর্তা; দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বপ্রাপ্তও তারা। কিন্তু জনগণের রক্ষক যখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন কি আর পুলিশ জনগণের রক্ষক আর বন্ধু হতে পারে? জনগণের রক্ষক এ বাহিনীর অনেক সদস্য আজ জড়িয়ে পড়ছেন বহুবিধ অপরাধকর্মে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। ব্যাপক ক্ষমতা পাওয়ার পর দিনদিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে পুলিশ।
গত কয়েক বছরে শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। মাদক নির্মূলে পুলিশ সদস্যরা একের পর এক অভিযান চালালেও পুলিশের কোন কোন সদস্যের বিরুদ্ধে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি মাদক ব্যবসায়ও তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সোমবার দিবাগত রাতে দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার চন্ডিপুর এলাকা থেকে আমিনুল ইসলাম নামের এক পুলিশ সদস্যকে হেরোইনসহ আটক করা হয়েছে। এসময় তার কাছ থেকে ৪৫ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয় বলে হাকিমপুর থানার ওসি খায়রুল বাশার শামীম জানায়।
আটক আমিনুল ইসলাম লালমনিরহাট জেলা সদরের চড় খট্টামারি গ্রামের আবু হানিফের ছেলে। তিনি দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার মধ্যপাড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্র ফাঁড়িতে কনস্টেবল পদে কর্মরত।
হাকিমপুর থানার ওসি খায়রুল বাশার শামীম বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি চন্ডিপুর গ্রামে একটি বাড়িতে মাদক আছে। পরে সেখানে অভিযান চালিয়ে ৪৫ গ্রাম হেরোইনসহ এক পুলিশ সদস্যকে আটক করা হয়। আটক পুলিশ সদস্য জেলার মধ্যপাড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্র ফাঁড়িতে কর্মরত। এর আগে তিনি হাকিমপুর থানাতে ছিলেন।
এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) আশঙ্কাজনক হারে মাদকাসক্ত সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। ফলে মাদক নিয়ে পুলিশ বিভাগে চলছে গোপন অনুসন্ধান। ইতোমধ্যে তিনশ’ পুলিশ সদস্যকে শনাক্ত করে ৯০ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আরও শতাধিক সদস্য চাকরি হারানোর তালিকায় রয়েছেন। পুলিশ বিভাগকে মাদক সেবনে বিরত রাখার জন্য নিয়মিত রোলকলের মাধ্যমে এ ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ।
২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ে চাকরি হারিয়েছেন পুলিশের এই সদস্যরা।
চাকরিচ্যুত সদস্যদের মধ্যে কনস্টেবলদের সংখ্যাই বেশি। আরও আছে উপপরিদর্শক (এসআই), সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই), সার্জেন্ট ও নায়েক।
দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার চন্ডিপুর এলাকা থেকে আমিনুল ইসলাম নামের এক পুলিশ সদস্যকে হেরোইনসহ আটক করা হয়েছে। এসময় তার কাছ থেকে ৪৫ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রথম পর্যায়ে কনস্টেবল থেকে সাব-ইন্সপেক্টর পর্যন্ত ডোপ টেস্টের আওতায় আনা হচ্ছে। কাউকে সন্দেহ হলেই তাকে ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আওতায় আনা হবে।
অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের কিছু সদস্য মাদক কারবারিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। এর পাশাপাশি অনেকে মাদক সেবনও করছেন। এমনকি কেউ কেউ মাদক কারবার করছে।
সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে কয়েক পুলিশ সদস্যকে মাদক কারবার ও সেবনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে কঠোর নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে, মাদকবিরোধী অভিযান জোরালো করার পাশাপাশি যেসব পুলিশ সদস্য মাদকাসক্ত বা মাদক কারবারে জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে। নির্দেশনা পেয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে। ডোপ টেস্টে যাদের পজিটিভ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নিদের্শনা দেয়া হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডিএমপি জানায়, ৮১ জন পুলিশ সদস্য মাদক নেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তাদের মধ্যে ৬০ জনই কনস্টেবল। এ ছাড়া একজন পরিদর্শক, আটজন এসআই, ট্রাফিকের একজন সার্জেন্ট, নায়েক ছয়জন এবং এএসআই আছেন পাঁচজন।
সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ফৌজদারি অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে মামলা হয়েছে এবং বিচার চলছে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় পুলিশের অপরাধ কাজে অধিক হারে জড়িয়ে পড়ার জন্য দীর্ঘদিনের ঘুণে ধরা সিস্টেমকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, ঔপনিবেশিক আমলের কাঠামো থেকে পুলিশ বাহিনী এখনো বের হতে পারেনি। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি করা যায়নি তাদের কাঠামো। ১৮৬১ সালের আইন দিয়ে পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে। এত দিনেও কাঠামোগত সংস্কার করা যায়নি। বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে মূল সমস্যা খতিয়ে দেখতে হবে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে আমাদের। ব্যক্তিবিশেষকে দোষারোপ করে লাভ নেই। পুরো সিস্টেমটা নিয়ে ভাবতে হবে। বিশেষ করে বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন ঘাট, প্রসিকিউসন, তদন্ত ব্যবস্থা আছে।
তারা বলেন, বিসিএস দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ভালো অফিসার ও কাজ দেখালে হবে না, জবাববদিহিতা স্বচ্ছতা জরুরি। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কর্ম পরিবেশ নিয়েও ভাবতে হবে। স্থানীয় এমপি, অর্থশালীদের সঙ্গে ওসিদের একটা আঁতাতের সম্পর্ক থাকে। তারা একজন আরেকজনকে প্রটেকশন দেয়। আর সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়। ওসি, এসআই লেভেলে সংস্কার জরুরি বলে মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসা অব্যাহত রয়েছে। কোথাও কোথাও মাদকের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগ আসে পুলিশের বিরুদ্ধে, কোথাওবা অস্ত্র বিক্রয়কারী হিসাবে, কোথাওবা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ, অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ, পুলিশের নেতৃত্বে মাদক পাচার চক্র গড়ে ওঠার অভিযোগ, চুরি ডাকাতি ইত্যাদি হেন কোনো অপরাধ নেই যা পুলিশ শব্দটির সাথে জুড়ে বসে নাই। প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে এমনসব অভিযোগ আসে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার হার আশংকাজনক। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে বিভিন্ন অপকর্মের। এবিষয়ে পুলিশের কর্তৃপক্ষসহ দেশের সরকাকেও নজর বাড়াতে হবে। কেননা, আইন রক্ষাকারী কর্তৃক একেরপর এক আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে দেশের আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা জন্মাবে। ফলশ্রুতিতে দেশে দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের খড়্গ চালানোর আগে পুলিশের ওপর চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, আগে পুলিশকে অপরাধমুক্তের চরিত্র অর্জন করতে হবে। নইলে সন্ত্রাসীদের নিকট পুলিশের যে ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এতে পুলিশ আর সন্তাসীদের মধ্যকার তফাৎ ঘুচে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩০
আপনার মতামত জানানঃ