তাইওয়ানের স্বাধীনতা সমর্থনকারীদের শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে চীন। তাইওয়ানের যেসব রাজনীতিবিদ দ্বীপটিকে চীনের সীমানা থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে চীন।
ইতিমধ্যে এই শাস্তির খাঁড়ায় পড়েছেন তাইওয়ানের ৩ রাজনীতিবিদ। তারা হলেন— তাইওয়ানের প্রধানমন্ত্রী সু সেং চেং, পার্লামেন্টের স্পিকার ইউ শিয়ি কুন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ উয়োউ।
চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে চরম উত্তেজনার মাঝে চীন প্রথমবারের মতো এমন শাস্তির কথা জানালো। তাইওয়ান দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের স্বতন্ত্র বলে দাবি করে আসছে। যদিও চীন তা অস্বীকার করে ক্রমাগত আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে বারবার অভিযোগ করছেন তাইওয়ানের নেতারা।
চীনের তাইওয়ানবিষয়ক কার্যালয়ের প্রধান সু সেং-চ্যাং,পার্লামেন্টের স্পিকার ইউ সি-কুন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ উ তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষ নেওয়াকে ‘একগুঁয়ে’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাইওয়ানের স্বাধীনতার সমর্থনকারীদের তালিকা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বেইজিংয়ের তাইওয়ান অ্যাফেয়ার্স দপ্তরের মুখপাত্র ঝু ফেংলিয়ান শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেন, এই তিন রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ— তারা তাইওয়ান প্রণালীর দুই তীরে (চীনের ও তাইওয়ানের ভূখণ্ডে) উত্তেজনা উস্কে দিচ্ছেন এবং তাইওয়ানকে চীনের সীমানা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করার জন্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন।
ঝু আরও বলেন, চীন তাইওয়ানের স্বাধীনতার সমর্থকদের বার্তা দিতে চায় যে, যারা তাদের পূর্বপুরুষদের ভুলে যায়, মাতৃভূমির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং দেশকে বিভক্ত করে, তাদের কখনই ভালো হবে না, তারা জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হবে এবং ইতিহাস তাদের বিচার করবে।
এই ‘অপরাধের’ শাস্তি হিসেবে তিন রাজনীতিবিদ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের চীন, হংকং ও ম্যাকাও ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বলে বিবৃতিতে জানিয়েছেন ঝু ফেংলিয়ান।
বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, তাইওয়ানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তালিকা তৈরি করছে বেইজিংয়ের দপ্তর এবং তালিকায় অন্তর্ভুক্ত সব রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধি দল তাইওয়ান সফরে গিয়ে সেখানকার রাষ্ট্রপতি সাই ইং ওয়েনকে আশ্বাস দেন, কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ ভূখণ্ড একা নয়। তাইওয়ানের স্বাধীনতার সংগ্রাম যেন আরও জোরদার হয়, সে বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তৎপরতা চালাবে বলেও জানান তারা।
ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলের সফরের এক দিন পরই এই বিবৃতি দিল বেইজিংয়ের তাইওয়ান অ্যাফেয়ার্স দপ্তর।
এদিকে, সদ্য বেইজিংয়ের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া তাইওয়ানের প্রধানমন্ত্রী সু সেং চেং সাংবাদিকদের জানিয়েছেন তিনি বেইজিংয়ের এই পদক্ষেপে ভীত নন।
সু সেং চেং বলেন, ‘তারা (চীন) যে অন্যায়ভাবে তাইওয়ানকে দখল করে রেখেছে, সাম্প্রতিক পদক্ষেপে তা আরও একবার প্রমাণিত হলো।’
গত ৯ অক্টোবর তাইওয়ানকে পুনরায় একত্র করার ঘোষণা দেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এর পাল্টা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট তাসাই ইন-ওয়েন। জাতীয় দিবসে (১০ অক্টোবর) বেইজিংকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রেসিডেন্ট তাসাই ইন-ওয়েন বলেন, তাইওয়ান কখনও চীনের কাছে মাথা নত করবে না।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, বেইজিং ধারাবাহিকভাবে তাইওয়ানকে রাজনৈতিক ও সামরিক চাপের মুখে ফেলেছে। প্রতিনিয়ত তাইওয়ানের আকাশে চীনা যুদ্ধবিমান টহল দিচ্ছে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই তাইওয়ানের আকাশসীমায় টহল দিয়েছে বেইজিংয়ের ১৪৯টি সামরিক বিমান।
এক সময়ের স্বাধীন রাষ্ট্র তাইওয়ান আসলে পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ, যা তাইওয়ান প্রণালীর পূর্বদিকে চীনের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। গত ষাটের দশকে এক যুদ্ধে চীনের কাছে পরাজিত হয়ে স্বাধীনতা হারায় তাইওয়ান।
তবে এই দ্বীপ ভূখণ্ডের স্বাধীনতাকামী জনগণ বরাবরই চীনের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। দ্বীপটির স্বাধীনতার সংগ্রাম নতুন গতি পেয়েছে ২০১৬ সালে, তাসাই ইন-ওয়েন সেখানকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে।
তবে গত এক বছর ধরে চীন-তাইওয়ান সম্পর্কে যে পরিমাণ তিক্ততা দেখা যাচ্ছে, তা গত ৪০ বছরে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা।
চীন বরাবরই তাইওয়ানকে নিজেদের সীমানাভূক্ত অঞ্চল বলে দাবি করে আসছে। অন্যদিকে, তাইওয়ানের স্বাধীনতাকামী সরকারকে নিয়মিত আর্থিক, সামরিকসহ বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চীন যদি তাইওয়ানে সামরিক অভিযান শুরু করে, সেক্ষেত্রে তাইওয়ানকে সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্য প্রচারিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জো বাইডেনের উদ্দেশে সতর্কবার্তা দিয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিজেদের অভ্যন্তরীণ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো ইস্যুতে চীন কোনো প্রকার ছাড় দেবে না।
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন গত কয়েক বছর ধরেই শক্তি বৃদ্ধি করছে। একদিকে চীনের নৌবহরকে যেমন ঢেলে সাজানো হচ্ছে, তেমনি ওই অঞ্চলে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করছে চীন। এ নিয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। বাইডেন আসার পরেও এ বিষয়ে সম্পর্কের উন্নতি হয়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫২
আপনার মতামত জানানঃ