আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর গত কয়েক মাসে পুরো পাল্টে গেছে দেশটির চেহারা। একের পর এক এলাকার দখলে নিয়েছে তালিবান। এরই মধ্যে আফগান নারী ও পুরুষের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। নারীরা বাড়ির বাইরে গেলে অবশ্যই তাদের বোরকা পরতে হবে। এ ছাড়া এ সময় তাদের সঙ্গে অবশ্যই একজন পুরুষ থাকতে হবে। ফলে নারীদের বাইরে চলাফেরা কঠিন হয়ে পড়েছে। ভয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন নারীরা।
আফগানিস্তানে তালিবান সরকারের অধীনে নারীদের অধিকার হারানোর শঙ্কা সেই শুরু থেকেই। সময় যতো গড়াচ্ছে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে সেই শঙ্কা। এমনকি নতুন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যে নারী প্রতিনিধি রাখা হচ্ছে না, সেটির ইঙ্গিত আগে থেকেই দিয়েছেন গোষ্ঠীটির নেতারা। এছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি একেবারেই থাকছে না বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এমতাবস্থায় নিজেদের অধিকারের দাবিতে বিক্ষোভে নেমেছেন আফগান নারীরা। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের বাইরে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন আফগান নারীরা। এর বাইরে কাবুলের বিভিন্ন স্থানেও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এরইমধ্যে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় মাজার-ই-শরীফ শহরের একটি বাড়ি থেকে চার নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত নারীদের মধ্যে অন্তত একজন নারী অধিকারর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা বলে স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
ওই চার নারীকে হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে দুইজনকে আটক করা হয়েছে বলে তালিবানের অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কারি সায়েদ খোস্তি জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই দুই ব্যক্তি নিহত নারীদের বাড়িতে ডেকে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এ ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়েছে। আটকদের আদালতে তোলা হয়েছে।
খোস্তি নিহতদের পরিচয় জানাননি। তবে মাজার-ই-শরীফের এক সূত্র এএফপিকে জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ফ্রোজান সাফি নামে একজন নারী অধিকারকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রয়েছে।তিন মাস আগে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর কোনও নারী অধিকার কর্মী নিহতের কথা এই প্রথম জানা গেলো।
দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, ফ্রোজান সাফির মরদেহ মাজার-ই-শরিফের মর্গে শনাক্ত করা হয়েছে। ২০ অক্টোবর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন।
নিহতের বোন চিকিৎসক রিতা বলেন, আমরা তার পোশাক চিনতে পেরেছি। গুলিতে তার মুখ চেনা যাচ্ছে না। তার দেহে অনেক গুলি, অসংখ্য, মাথায়, হৃদপিণ্ডে, বুকে, কিডনি ও পায়ে গুলি রয়েছে।
সাফির বিয়ের আংটি ও ব্যাগ আনা হয়েছে জানিয়ে রিতা বলেন, আমরা জানি না কারা তাকে হত্যা করেছে।
২০ বছর পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে হঠিয়ে চলতি বছরের আগস্টে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা দখল করে রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত তালিবান।
দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা দখলের পর তালিবান আগের কঠোর মনোভাব থেকে সরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু নারীদের স্কুলে ফেরা এবং কর্মক্ষেত্রে ফেরার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাসহ নারীদের প্রতি তালিবানের বিরূপ মনোভাব অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি আফগানিস্তানের মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলে শিক্ষার্থী এবং পুরুষ শিক্ষকদের ফেরার অনুমতি দেয় তালিবান সরকার। কিন্তু মেয়েদের স্কুলে ফেরার অনুমতি দেয়নি। তারা কবে স্কুলে ফিরতে পারবে বিষয়টি স্পষ্টও করেনি। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে আফগান তালিবান সরকার। এ ছাড়া নারীদের নতুন সরকারেও রাখা হয়নি।
এর আগে ১৯৯৬-২০০১ সালে তালিবান সরকারের অধীনে নারীদের অধিকার সম্পূর্ণ হরণ করা হয়। কোনো মেয়ে স্কুলে যেতে পারতো না, বাইরে কাজ করতে পারতো না। সবাইকে বোরকা ও হিজাব পরিধান করতে হতো এবং বের হতে হলে পরিবারের একজন পুরুষ সদস্যকে বাধ্যতামূলত সঙ্গে রাখা লাগতো। এছাড়া তাদের জোর করে বাল্যবিবাহ দিতো তালিবান শাসকগোষ্ঠী।
তবে এবার ক্ষমতায় এসে তালিবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ইসলামি আইনের অধীনে তারা এবার নারীদের অধিকার নিশ্চিত করবে। যদিও সেটিতে এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না আফগান নারীরা।
এর মাঝেই তালিবান নির্দেশ দিয়েছে, নারীরা যেন আপাতত ঘরে থাকে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নারীদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়, তা অনেক তালিবান সদস্য এখনো জানে না। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরই নারীরা বাইরে কাজের সুযোগ পাবে। তবে এটাকে তালিবানের এক প্রকার কৌশল বলে মনে করছেন অনেকেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তালিবানের আফগান দখলের পর থেকেই দেশটিতে নারীদের অবস্থান নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। অত্যাচার নিপীড়নের পাশাপাশি বাড়ি থেকে কম বয়সী নারীদের জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া এমনকি মৃতদের ধর্ষণের অভিযোগও উঠেছে তালিবানের বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রা থমকে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। কর্মজীবী নারীদের উপর নেমে আসছে নিয়মের খড়গ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৭
আপনার মতামত জানানঃ