আঠারো-উনিশ শতকে কানাডা সরকার ও রোমান ক্যাথলিক চার্চের যোগসাজশে আদিবাসীদের সঙ্গে হওয়া বর্বর আচরণের অধ্যায় ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে। আদিবাসী সন্তানদের আধুনিক সমাজে খাপ খাওয়ানোর নামে জোরপূর্বক আবাসিক স্কুলে রাখার যে উদ্যোগ নিয়েছিল তৎকালীন সরকার, তার ফলাফল হয়েছিল ভয়াবহ। স্কুলগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যায় কয়েক হাজার শিশু। পরে স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়া হলেও কৌশলে চাপা পড়ে যায় আদিবাসী শিশুমৃত্যুর বিষয়টি। তবে সম্প্রতি ওই ধরনের বেশ কয়েকটি স্কুলে কয়েকশ’ কবরের সন্ধান পাওয়ার পর এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে।
এরমধ্যেই বৈষম্যের শিকার হওয়া কানাডার আদিবাসী শিশুদের বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ পরিবর্তন করতে দেশটির ফেডারেল কোর্ট অফ আপিলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।আদালতের প্রতি স্থানীয় সময় শুক্রবার ওই আহ্বান জানায় কানাডা সরকার।
বিবিসি ও বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, আদালতের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছে কানাডা সরকার। আদিবাসী শিশুদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার পরিবর্তে চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে তারা।
কানাডা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ক্ষতিপূরণ দেয়াটা জরুরি। তবে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফস্টার কেয়ারে (রাষ্ট্রীয় সেবায় দেখভাল) রাখা আদিবাসী শিশুদের ওই ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
আপিলের নোটিশে কানাডা সরকার বলে, ‘আদিবাসী শিশুদের প্রতি কাঠামোগত বৈষম্য হয়েছে, তা আমরা স্বীকার করছি। সরকারের অসদাচরণের কারণে আদিবাসীদের যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে আমাদের দ্বিমত নেই। তবে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ের সমাধান আরও কার্যকর হতে পারে।’
আদিবাসীদের সঙ্গে হওয়া নীতিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের দায় কানাডা সরকার নিলেও ক্ষতিপূরণে রাজি নয় তারা।
কানাডা সরকারের আপিলে হতাশা ব্যক্ত করেছেন টানা ১৪ বছর ধরে আদিবাসী শিশুদের পক্ষে আইনি লড়াই করা অধিকারকর্মীরা।
গত মাসে কানাডার কেন্দ্রীয় আদালত জানতে পারে, আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিশুদের পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়নি কানাডা সরকার। এতে প্রায় ৫০ হাজার শিশু বৈষম্যের শিকার হয়।
এরপর ভুক্তভোগী প্রতিটি শিশুকে ৪০ হাজার কানাডীয় ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে কানাডার সরকারকে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় আদালত।
গত কয়েক মাসে কানাডার আদিবাসী শিশুসংক্রান্ত বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা হয়।
মে মাসে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া অঙ্গরাজ্যে পরিত্যক্ত এক আবাসিক স্কুল থেকে ২১৫টি আদিবাসী শিশুর দেহাবশেষ উদ্ধারের মাধ্যমে প্রথম এই আলোচনার সূত্রপাত হয়।
পরের মাসে সাসকাচেওয়ান প্রদেশের পুরনো একটি আদিবাসী আবাসিক স্কুলে মেলে ৭৫১টি কোনও চিহ্ন না থাকা কবর। সর্বশেষ বুধবার ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যের ক্রানব্রুক এলাকার একটি স্কুলের কাছে ১৮২টি কবর পাওয়া যায়।
আর গির্জা ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, অ্যালবার্টা ও নোভা স্কটিশ প্রদেশে। কোনো ঘটনাতেই এখন পর্যন্ত কোনো গ্রেপ্তার বা অভিযোগ গঠন করা হয়নি।
সরকারি অর্থায়নে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর পরিচালনায় ওই স্কুলগুলোতে আদিবাসী শিশুদের রাখা হতো।
১৮৬৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এসব বোর্ডিং স্কুলে এক লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি আদিবাসী শিশুকে তাদের পরিবারগুলো থেকে নিয়ে এসে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল।
এসব শিশুদের প্রায়ই তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলতে ও তাদের সংস্কৃতি চর্চা করতে দেওয়া হতো না। তারা ছিল অপুষ্টির শিকার; তাদেরকে এমনকী শারীরিক ও যৌন নিগ্রহও সইতে হয়েছে।
২০১৫ সালে কানাডার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন আবাসিক স্কুলগুলোর ওই চর্চাকে ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’ আখ্যা দেয়।
যারা এসব বোর্ডিং থেকে শেষ পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পেরেছে তারা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানায়, ক্ষুধা আর একাকিত্ব তাদের তাড়া করে ফিরত; স্কুলে নিয়মিত ভয় দেখানো ও বল প্রয়োগ করা হতো।
দেশটির আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সে সময় দেশটিতে ১৩৯ টি এ রকম আবাসিক স্কুল ছিল। কানাডার কেন্দ্রীয় ক্যাথলিক গির্জার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলসমূহ পরিচালনা করতেন ক্যাথলিক খ্রিস্টান মিশনারিরা।
কয়েক লাখ আদিবাসী শিশুকে জোরপূর্বক তাদের বাবা-মা ও অভিভাবকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভর্তি করা হয়েছিল এসব স্কুলে। নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলা ও নিজেদের ধর্মবিশ্বাস চর্চা নিষিদ্ধ ছিল এই শিশুদের জন্য। তাদের সঙ্গে আচরণ করা হতো ক্রীতদাসের মতো এবং স্কুল শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের হাতে নিয়মিত শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।
পাশাপাশি আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও জীবনযাপন নিয়ে কটাক্ষ ও ব্যাঙ্গ করাও ছিল সেই স্কুলগুলোর নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ। সহ্যের অতীত নির্যাতনের ফলে বহু শিশুর মৃত্যু হতো। তখন তাদেরকে মাটিচাপা দেওয়া হতো। এসব সমাধিই এখন গণকবর।
দেশটির আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৮০০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠা করা শুরু এসব স্কুল এবং সর্বশেষ স্কুলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয় ১৯৯৬ সালে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২১
আপনার মতামত জানানঃ