তাইওয়ান প্রণালিতে সামরিক তৎপরতা বাড়িয়েছে চীন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে এটাই ছিল বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনাম। কিন্তু হাজার হাজার মাইল পশ্চিমে চীনের আরেক সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে তাইওয়ানের আগে ওই সীমান্তেই বিরোধ উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা বেশি।
প্রায় ১৬ মাস আগে চীন ও ভারতের সেনারা প্রাণঘাতী এক সংঘর্ষে জড়ান। হিমালয়ের পাদদেশে দুর্গম এলাকায় দুই দেশের সীমানা বিভাজনকারী প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) এই সংঘর্ষ কোনো অস্ত্র দিয়ে নয়, হয়েছিল পেশিশক্তি দিয়ে। পারমাণবিক ক্ষমতাধর দুই দেশের মধ্যে এই সীমান্ত বিতর্কিত এবং দুর্বলভাবে চিহ্নিত। এখন এটা নিয়ে উত্তেজনা আবার বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
চীন সীমান্তে এবার যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করেছে ভারত। সম্প্রতি এসব অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছে বলে আজ শুক্রবার দেশটির সংবাদ মাধ্যম খবর দিয়েছে। চীনকে ঠেকাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছে ভারত। সীমান্তে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন তারই প্রতিফলন।
ভুটান ও তিব্বত সীমান্তবর্তী তায়াং উপত্যকায় এসব অস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছে। এলাকাটি চীন নিজেদের দাবি করে, তবে এর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ভারতের হাতে। এলাকাটির রাজনৈতিক ও সামরিক গুরুত্বও রয়েছে।
চীনের সামরিক অভিযানের মুখে ১৯৫৯ সালে দালাই লামা যখন ভারতে পালিয়ে যান তখন তিনি তায়াং উপত্যকা ধরে প্রবেশ করেন। তার তিন বছরের মাথায় ওই এলাকায় ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ হয়।
বর্তমানে ওই এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি চিনুক হেলিকপ্টার, হালকা কামান এবং রাইফেল মোতায়েন করেছে ভারত। পাশাপাশি নিজেদের তৈরি সুপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং নতুন প্রজন্মের নজরদারি ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে দিল্লি। গত কয়েক বছর ধরে এসব অস্ত্র সংগ্রহ করেছে ভারত।
নতুন প্রতিরক্ষা সক্ষমতা দেখাতে গত সপ্তাহে ওই অঞ্চলে সাংবাদিকদের একটি গ্রুপের সফরের আয়োজন করে ভারত। পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মনোজ পান্ডে বলেন, ‘মাউন্টেইন স্ট্রাইক কর্পস সম্পূর্ণ কার্যক্ষম। সব ইউনিট পূর্ণ প্রস্তুত এবং সজ্জিত রয়েছে।’
খবরে বলা হয়েছে, বেইজিংকে মোকাবিলা করতে মার্কিন-ভারত প্রতিরক্ষা সম্পর্ক উন্নীত করার পাশাপাশি মার্কিন চিনুক হেলিকপ্টারগুলো চীনা সীমান্তের কাছে মোতায়েন করা হয়েছে।
এ ছাড়া মোতায়েন করা মার্কিন অস্ত্রের মধ্যে আরও রয়েছে—আল্ট্রা লাইট টাউড হাউ-ইটজার রাইফেল, নিজেদের তৈরি সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল এবং সীমান্ত নজরদারির জন্য অত্যাধুনিক সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম।
মার্কিন এ অস্ত্রগুলো গত কয়েক বছরে চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ভারত কিনেছে বলেও জানায় ব্লুমবার্গ।
চীন সীমান্তে এবার যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করেছে ভারত। সম্প্রতি এসব অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছে বলে আজ শুক্রবার দেশটির সংবাদ মাধ্যম খবর দিয়েছে। চীনকে ঠেকাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছে ভারত। সীমান্তে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন তারই প্রতিফলন।
ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডার মনোজ পান্ডের বরাত দিয়ে ব্লুমবার্গ বলছে, বুটস, আর্মার, আর্টিলারি ও এয়ার সাপোর্টকে সমন্বিত করা হয়েছে বিরোধপূর্ণ চীনা সীমান্তে। পাশাপাশি মাউন্টেন স্ট্রাইকস কর্পস, কমব্যাট এবং কমব্যাট সাপোর্ট ইউনিট মোতায়েন করা হয়েছে।
গত বছরের জুনের সংঘর্ষের পর এ পর্যন্ত ১৩ দফা সামরিক বৈঠক হয়েছে। সবশেষ বৈঠকটি হয়েছে ১৭ অক্টোবর। এবারের আলোচনার সমাপ্তি ভালো হয়নি। আগের আলোচনাগুলোয় সীমান্তে দুই পক্ষের দাবি নিয়ে সামান্য অগ্রগতি হলেও সবশেষ বৈঠকের পরদিন ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় চীনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতা করার অভিযোগ তুলেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ভারত তার অবস্থান থেকে এটা দেখতে পেয়েছে যে, এলএসি বরাবর স্থিতাবস্থা নষ্ট হয়েছে চীনের একতরফা কার্যকলাপ এবং তাদের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি লঙ্ঘনের কারণে। কাজেই ভারতীয় পক্ষ বাকি এলাকাগুলোর সমস্যা সমাধানের জন্য গঠনমূলক পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু চীন রাজি হয়নি। এ ছাড়া চীনের পক্ষ থেকে কোনো দূরদর্শী প্রস্তাবও দেওয়া হয়নি।’
ত্রয়োদশ বৈঠকের আগে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নারাভানে বলেছিলেন, চীন এলএসির ওপারে সেনা না সরালে ভারতও সেনা সরাবে না। বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার ফলে ভারতও সেনাদের সতর্ক থাকার ওপর জোর দিয়েছে। ভারতীয় বাহিনীর ধারণা, এলএসিতে চীন ৬০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। পাশাপাশি জানা যাচ্ছে, ভারতের সেনাসংখ্যাও ৫০-৬০ হাজারের মতো।
বেইজিং অবশ্য এই পরিস্থিতিকে অন্যভাবে দেখছে। পিপলস লিবারেশন আর্মির ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের মুখপাত্র কর্নেল লং শাওহুয়া বলেন, ‘সীমান্ত পরিস্থিতি সহজ করতে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছে চীন। দুই সামরিক বাহিনীর মধ্যে সম্পর্কের সার্বিক পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য পুরো আন্তরিকতা প্রদর্শন করেছে। তবে, ভারত এখনো অযৌক্তিক ও অবাস্তব দাবিতে অটল। এতে আলোচনা আরও কঠিন হয়েছে।’
চীনের রাষ্ট্র পরিচালিত গ্লোবাল টাইমস ট্যাবলয়েডের একটি বিস্তৃত নিবন্ধে ‘সীমান্তের পূর্ব অংশে নতুন করে ঘটনা ঘটানো হচ্ছে’ বলে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে।
যদিও এ বছরের শুরুর দিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বেশ কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, সত্যিকার অর্থে অগ্রগতি হচ্ছে। উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবিতেও দেখা গিয়েছিল, সীমান্তে থাকা সেনা সমাবেশ সরাচ্ছে চীন। এতে করে ওই অঞ্চল থেকে বিশ্বের মনযোগ সরে যায়।
গ্লোবাল টাইমস বলেছে, সেনাদের এমন মুখোমুখি অবস্থানের কারণে সীমান্তে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। তবে গ্লোবাল টাইমসের এই প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্যের সত্যতা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিশেষজ্ঞরা নতুন করে সংঘাত শুরুর ঝুঁকির ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। তারা বলছেন, চীনের শুধু ভারতের ঔদ্ধত্য চাওয়াগুলো প্রত্যাখ্যান করলেই চলবে না, ভারতের নয়া সামরিক আগ্রাসন থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’
গ্লোবাল টাইমসের এর আগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, কিছুদিন আগেই ওই অঞ্চলে মোতায়েন থাকা চীনের পিএলএর সেনারা প্রাত্যহিক কাজের পরিবেশকে উদ্বেগজনক বর্ণনা করে সতর্ক থাকার কথা জানিয়েছিলেন। ওই প্রতিবেদনে সীমান্ত অঞ্চলে চীনের নতুন অবকাঠামো নির্মাণের খবরও জানানো হয়েছিল।
চীন-ভারত সীমান্ত পরিস্থিতি আবার কেন উত্তপ্ত হচ্ছে, এমন প্রশ্নের পক্ষপাতদুষ্ট জবাব মিলছে চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমে। একইভাবে তাইওয়ানের সঙ্গে উত্তেজনা নিয়েও মত দেওয়া হয়ে থাকে। গত এক মাসে তাইওয়ানে দেড় শতাধিক চীনা যুদ্ধবিমানে মহড়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছিল গ্লোবাল টাইমস।
গত বছর চীনা সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রাণঘাতী সংঘাতের পর সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদারের পদক্ষেপ নেয় ভারত। গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ওই সংঘাতে অন্তত ২০ ভারতীয় এবং চার চীনা সেনা নিহত হয়। দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা চললেও সীমান্ত উত্তেজনা এখনও নিরসন হয়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২২
আপনার মতামত জানানঃ