আফগানিস্তান তালিবানের দখলে। এর প্রভাব কাশ্মীর সমস্যায় পড়বে বলে মনে করছেন একাধিক ভারতীয় বিশেষজ্ঞ। ইতিমধ্যেই কাশ্মীরে বাড়ছে জঙ্গি তৎপরতা। আর জঙ্গি দমনে অভিযানও চালানো হচ্ছে একের পর এক। পাশাপাশি ভারত -শাসিত কাশ্মীরে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বেসামরিক মানুষ হত্যার ঘটনা ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি করেছে; বিশেষ করে এই অঞ্চলের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে।
এর মাঝেই টানা ১৪তম দিনে প্রবেশ করলো জম্মু ও কাশ্মিরের জঙ্গিবিরোধী অভিযান। রবিবার (২৪ অক্টোবর) পুঞ্চ জেলায় ভারি গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত একজন পাকিস্তানি জঙ্গি আহত হওয়ার কথা জানা গেছে।
একইসঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সৈনিক ও দুই পুলিশও আহত হয়েছে। এসব জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি। প্রতিবেদনে বলা হয়, সকালে পুঞ্চ জেলার একটি জঙ্গলে সেনা ও পুলিশের যৌথ অনুসন্ধান দলকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে।
ভাটা ডুরিয়ান এলাকার একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানোর সময় এ ঘটনা ঘটে। এতে দুই পুলিশ, একজন সেনা জওয়ান এবং একজন পাকিস্তানি সন্ত্রাসী আহত হয়েছে।
ভারতীয় সেনা নিহতের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ১১ অক্টোবর জানা যায়, জম্মু-কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলায় ৪৮ ঘণ্টায় সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে দেশটির সেনাবাহিনীর অন্তত ৯ সদস্য নিহত হয়েছে।
কাশ্মীরে তালিবানের প্রভাব
এদিকে, আফগানিস্তানের চলমান পরিস্থিতির প্রভাব পড়তে পারে ভারতশাসিত জম্মু-কাশ্মিরেও; গতকাল শনিবার (২৩ অক্টোবর) এমন মন্তব্য করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রথম চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ (সি
ডিএস) জেনারেল বিপিন রাওয়াত। তিনি বলছেন, ‘আফগানিস্তানে যা হচ্ছে, তার প্রভাব জম্মু-কাশ্মিরেও পড়তে পারে। আমাদের যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে।’
এই সেনাপ্রধান বলেন, ‘আফগানিস্তানে কী হচ্ছে, তা সবারই জানা। এর প্রভাব জম্মু-কাশ্মিরের ওপরও পড়তে পারে। আমাদের এর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। সীমান্তগুলো বন্ধ করা এবং কড়া নজরদারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাইরে থেকে কে বা কারা আসছে, তার ওপর কড়া নজর রাখতে হবে। নিয়মিত পরীক্ষা চালাতে হবে।’
ভারতীয় এই চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বলেন, ‘কেউ আমাদের নিরাপত্তা দিতে আসবে না, আমাদের নিজেদেরই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে, নিজেদের মানুষদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের অভ্য়ন্তরীণ সুরক্ষা আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং দেশকে সুরক্ষা দিতে আমার মনে হয় সকলকেই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে অবগত করা উচিত। যদি এই অঞ্চল বা দেশের যেকোনো প্রান্তে বসবাসকারী মানুষ দেশের প্রতি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে জানতে পারেন, তবে আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারবো।’
এর আগেও আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন সিডিএস জেনারেল বিপিন রাওয়াত। গতমাসেই তিনি বলেছিলেন, ‘শুধুমাত্র সময়ই বলবে এরপর আফগানিস্তানের কী হবে। তালিবান এতো দ্রুত আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে নেবে তা আসলে আমাদের কারও কাছেই প্রত্যাশিত ছিল না। পরিস্থিতি আরও খারাপ দিকেই যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’
জেনারেল রাওয়াত সেই সময়ে উল্লেখ করেছিলেন, ভারত-বিরোধী আগ্রাসী নীতি নিয়ে চীন ও পাকিস্তান যে পেছন থেকে তালিবানদের সহায়তা করছে, তা দিনের আলোর মত স্পষ্ট এবং আরও বেশ কিছু দেশ এই উস্কানির পেছনে জড়িত রয়েছে। এর জন্য সামরিকভাবে ভারতকে সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে বলেই সেসময় দাবি করেন তিনি।
কী বলছে অতীত?
কাশ্মীর বিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন জেনের বক্তব্য, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালিবান যখন আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ছিল, তখন বহু তালিবান যোদ্ধাকে কাশ্মীরে এসে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলিতে প্রশিক্ষণ দিতে দেখা গেছে। তালিবান যোদ্ধারা কাশ্মীরের সীমান্ত অঞ্চলে মিছিল করেছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে।
সালাউদ্দিন বলেন, ”দীর্ঘ ২০ বছর ধরে তালিবান যোদ্ধারা আফগানিস্তানে ব্যস্ত ছিল। কাশ্মীরে তারা বড় একটা আসেনি। আফগানিস্তান তাদের হাতে চলে আসায় এবার ওই যোদ্ধাদের একটি অংশ কাশ্মীরে আসতে পারে। এর আগেও তাই হয়েছিল।”
সালাউদ্দিন জানান, আফগানিস্তানে তালিবানের সঙ্গে বহু কাশ্মীরী যোদ্ধা ছিল। এবার তারা ফিরে আসছে। তারাই সীমান্ত অঞ্চলে বহু জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশ নিচ্ছে। কাশ্মীরী যুবকরাও নতুন করে সেই সব জায়গায় যোগ দিচ্ছে।
ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এক অফিসার জানান, তালিবান আফগানিস্তান দখল করায় ভারত অত্যন্ত চিন্তিত। যে কারণে, তালিবানের সঙ্গে একাধারে সরাসরি এবং ব্যাক-চ্যানেলে আলোচনা জারি রেখেছে ভারত।
এ কথা প্রায় সর্বজনবিদিত যে, পাকিস্তানের আইএসআই তালিবানকে মদত দিয়েছে। পাকিস্তানের পশ্চিমপ্রান্তে আফগান বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানের যে দীর্ঘদিনের শত্রুতা এবং সীমান্ত সংঘাত, তালিবানের আমলে তা কমবে বলে মনে করছে ভারত। ফলে পাক ফৌজ কাশ্মীর সীমান্তে অশান্তি আরো বাড়াতে পারে বলে মনে করছে ভারত।
একইসঙ্গে তালিবান যোদ্ধারা কাশ্মীরে ঢুকবে বলেও তারা মনে করছে। ইতিমধ্যেই পাক-কাশ্মীরে তাদের ঢোকার ছবি ভাইরাল হয়েছে। আফগানিস্তানের জমিতে ভারত-বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দেওয়া হতে পারে বলেও ভারতের আশঙ্কা।
ভারতীয় সেনা বাহিনীর সাবেক লেফটন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেন, দোহার সাম্প্রতিক বৈঠকে তালিবানের কাছে একাধিক আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ভারত। তার মধ্যে অন্যতম আফগানিস্তানের জমিতে সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়া। এখন দেখার তালিবান বিষয়টিকে কীভাবে দেখে। ভারত যে কাশ্মীর নিয়ে চিন্তিত তা স্পষ্ট বলেই মনে করেন উৎপল।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ