চীন বরাবরই তাইওয়ানকে নিজেদের অধিভুক্ত প্রদেশ হিসেবে দাবি করে আসছে এবং এই দাবিকে শক্তিশালী করতে তাইওয়ানের ওপর রাজনৈতিক ও সামরিক চাপ প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে চলছে দেশটি। কিন্তু এক সময়ের সার্বভৌম দেশ তাইওয়ান বরাবরই চীনের এই দাবি অস্বীকার করে নিজেদের স্বাধীনতার পক্ষে অনড় অবস্থানে থেকেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অঞ্চলটিতে উত্তেজনা বেড়েছে এবং দ্বীপটিকে নিয়ন্ত্রণে পেতে শক্তি ব্যবহারের হুঁশিয়ারিও দিয়েছে চীন।
সাম্প্রতিক সময়ে তাইওয়ান ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাইওয়ানের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে আসছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের উত্তেজনার এটিও একটি কারণ।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে তাইওয়ান। শুধু তাই নয়, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গোপনে তাইওয়ানের সেনাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সামরিক বাহিনীর স্পেশাল অপারেশনস ফোর্সেস এবং মেরিন সেনারা অত্যন্ত গোপনে এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটি করছেন। যা চীনের ক্ষোভ বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি করেছে। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার (৭ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এই তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে প্রভাবশালী মার্কিন এই সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, চীনের ক্রমবর্ধমান হুমকির মধ্যেই তাইওয়ানের মাটিতেই তাদের সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে প্রায় দুই ডজন মার্কিন সেনা। ‘অন্তত গত এক বছর ধরে’ অত্যন্ত গোপনে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে।
প্রতিবেদনে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার উদ্ধৃতিও যুক্ত করা হয়। তবে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’র এই প্রতিবেদন সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
এদিকে বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটির তথ্য নিশ্চিত বা অস্বীকার কোনোটিই করেনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন। তবে পেন্টাগনের মুখপাত্র জন সাপল বলছেন, তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা বিষয়ক প্রয়োজনীয়তা পরিমাপ করেই দেশটির সামরিক বাহিনীকে সহায়তা দিয়ে থাকে যুত্তরাষ্ট্র।
এক বিবৃতিতে সাপল বলছেন, ‘তাইওয়ানের বিরুদ্ধে চীনের বর্তমান হুমকি মোকাবিলায় দেশটিতে আমাদের সহায়তা ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে। আর তাই সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় করা প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান দেখাতে আমরা বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
অবশ্য তাইওয়ানের স্থল ও নৌবাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষণের বিষয়টি গত বছরের নভেম্বরে ছোট এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির সংবাদমাধ্যমেও উঠে এসেছিল। সেসময় তাইওয়ানের নেভাল কমান্ডের উদ্ধৃতি দিয়ে সেখানকার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল যে, তাইওয়ানের সামরিক বাহিনীর স্পেশাল ফোর্স এবং নৌবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে ছোট ছোট নৌকা ও উভচর বাহনে করে দেশটিতে পৌঁছেছে মার্কিন সেনারা।
তাইওয়ানের নৌ-কমান্ডারের বরাত দিয়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেই খবরের সত্যতার প্রতিফলন ঘটল ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে।
তবে সে সময় তাইওয়ানের গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সত্যতা নাকচ করেছিল তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্র। তখন উভয় পক্ষ বলেছিল, কোনো প্রশিক্ষণ নয়, তারা দ্বিপক্ষীয় সামরিক বিনিময় ও সহযোগিতায় যুক্ত।
চীনের ক্রমবর্ধমান হুমকির মধ্যেই তাইওয়ানের মাটিতেই তাদের সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে প্রায় দুই ডজন মার্কিন সেনা। ‘অন্তত গত এক বছর ধরে’ অত্যন্ত গোপনে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে।
এদিকে, গত বুধবার (৬ অক্টোবর) চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কাছে ফোন করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এসময় তাদের মধ্যে তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে কথা হয়েছে।
হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাইডেন বলেন, চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাইওয়ান চুক্তির সঙ্গে আমরা একমত। আমার বিশ্বাস তিনি (জিনপিং) চুক্তির বাইরে কিছুই করবেন না।
সম্প্রতি তাইওয়ানের আকাশসীমায় রেকর্ডসংখ্যক চীনা যুদ্ধবিমান মহড়া চালায়। এটিকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন উসকানি’ হিসেবে উল্লেখ করে চীনকে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে তাইওয়ান।
চলতি মাসে চীনের প্রায় ১৫০টি যুদ্ধবিমান তাইওয়ানের আকাশসীমায় ‘অনুপ্রবেশ’ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে ওই অঞ্চলে তীব্র উত্তেজনা শুরু হয়েছে। তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে চীন।
অঞ্চলটিতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চীন এমন উসকানিমূলক কার্যকলাপ করছে বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ানকে নিশানা করে চীনের সামরিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, রাজনৈতিক চাপ ও জবরদস্তি বন্ধ করতে বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
তাইওয়ান প্রণালী থেকে শুরু করে এটি এমনকি চীনের মূল ভূখণ্ড পর্যন্ত প্রসারিত। এই অঞ্চলের মধ্যে একটি সীমারেখা রয়েছে যেটি কেউ অতিক্রম করলে তাইওয়ান মনে করে তার বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালানো হচ্ছে।
এদিকে চীনের সাথে তাইওয়ানের সম্পর্কের উত্তেজনা গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সতর্ক করে দিয়েছেন যে, দুই পক্ষের মধ্যে দুর্ঘটনাক্রমে সংঘাত বেঁধে যেতে পারে।
তাইওয়ানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে চীন তার দেশের ওপর সর্বাত্মক হামলা চালানোর সক্ষমতা অর্জন করবে। তিনি এসব কথা বলছিলেন যখন তাইপের একটি সংসদীয় কমিটিতে মিসাইল এবং যুদ্ধজাহাজ কেনার জন্য শত শত কোটি ডলারের একটি প্রতিরক্ষা বিল নিয়ে আলোচনা চলছে।
তাইওয়ানের ওপর চীন এখনই হামলা চালানোর ক্ষমতা রাখে— একথা স্বীকার করে তিনি বলেন, আগামী দিনগুলোতে এই হামলা চালানো অনেক সহজ হয়ে আসবে। তবে এ সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত আর কিছু বলেননি।
চীনে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টরা শাসন ক্ষমতা দখল করার পর তাইওয়ান মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা হয়ে যায়। বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন যে, তাইওয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারে বলে চীন ক্রমশই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট ছাই ইং-ওয়ান যাতে এমন কোন ঘোষণা না করেন, সেটা চীন ঠেকাতে চায়।
সম্প্রতি খোলাখুলিভাবে চীনের সামরিক শক্তি প্রদর্শন নিয়ে তাইওয়ানের সমর্থক পশ্চিমা দেশগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, ‘তাইওয়ান চুক্তি’ মেনে চলার কথা চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন।
বাইডেন দৃশ্যত ওয়াশিংটনের দীর্ঘদিনের ‘এক চীন’ নীতির প্রতি ইঙ্গিত করছেন, যেখানে রাষ্ট্র হিসেবে তাইওয়ান নয় চীনকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। তবে এ চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সাথে ‘জোরদার অনানুষ্ঠানিক’ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে।
তাইওয়ান রিলেশন্স অ্যাক্টে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের প্রতিরক্ষায় সহায়তা করবে। এই আইনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে এখন উত্তেজনা বেড়ে গেলেও তা ১৯৯৬ সালের পর্যায়ে পৌঁছেনি। ঐ বছর তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ভণ্ডুল করার জন্য চীন মিসাইল পরীক্ষা চালিয়েছিল এবং তাদের ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। তবে এবারও সেসবের আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মোড়ে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৭
আপনার মতামত জানানঃ