জানলে হয়তো চমকে যাবেন, করোনা মহামারি শুরুর কয়েক মাস আগেই উহানের বিজ্ঞানীরা কোন ভাইরাস নিয়ে কাজ করছিলেন অথবা কোন ভাইরাস তৈরি করছিলেন, তা যাতে কেউ জানতে না পারে, সেজন্য ভাইরাল স্ট্রেনের উহান ডাটাবেজ লুকিয়ে ফেলা হয়।
এবার এই ঘটনার পেছনে লুকিয়ে থাকা সত্য ফাঁস হলো। জানা গেছে, কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হওয়ার আগে মার্কিন ও চীনা বিজ্ঞানীরা একটি নতুন করোনাভাইরাস তৈরির পরিকল্পনা করছিলেন। গত মাসে ইউএস ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সিতে (ডারপা) দাখিল করা এক আবেদন থেকে জানা যায়, একদল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী একই ধরনের স্ট্রেনের জেনেটিক তথ্য মিশিয়ে একটি নতুন ভাইরাস তৈরির পরিকল্পনা করছিলেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (ডব্লিউএইচও) কর্মরত একজন জিন বিশেষজ্ঞ নতুন এ তথ্য ফাঁস করেছেন। প্রস্তাবটি বিস্তারিত যাচাই-বাছাইয়ের পর তিনি এ তথ্য ফাঁস করেন। তিনি বলেন, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি এভাবে তৈরি করা হলে বোঝা যেত প্রকৃতিতে এর কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের আর কোনো ভাইরাস কেন পাওয়া যায়নি।
এখন পর্যন্ত সার্স-কোভ-২-এর সবচেয়ে কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের প্রাকৃতিক ভাইরাস হচ্ছে ব্যানাল-৫২ নামের একটি স্ট্রেন। গত মাসে লাওসে এই স্ট্রেনের হদিস পাওয়া যায়। সার্স-কোভ-২-এর সঙ্গে এর জিনোমের ৯৬ দশমিক ৮ শতাংশ মিলি রয়েছে।
তবু বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, সার্স-কোভ২-এর সঙ্গে ৯৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ মিলসম্পন্ন সরাসরি কোনো পূর্বপুরুষ প্রকৃতিতে পাওয়া যাবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো স্ট্রেন পাওয়া যায়নি।
মহামারির উৎপত্তি বিশ্লেষণ করা সংস্থা ড্রাসটিক-এর কাছে ফাঁস করা ডারপা প্রস্তাবে দেখা গেছে, বিজ্ঞানীদের পরিকল্পনা ছিল প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট করোনাভাইরাস থেকে সিকোয়েন্স নিয়ে এগুলো ব্যবহার করে নতুন সিকোয়েন্স বানানো। সেই নতুন সিকোয়েন্সে সব গড়পড়তা স্ট্রেনের বৈশিষ্ট্যই থাকত।
ডব্লিউএইচওর ওই বিশেষজ্ঞ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, এর মানে হলো, তারা একই ধরনের করোনাভাইরাসের নানা ধরনের সিকোয়েন্স নিয়ে একটি নতুন সিকোয়েন্স তৈরি করতেন। এটি সম্পূর্ণ নতুন ভাইরাসের সিকোয়েন্স হতো। এর সঙ্গে কোনো স্ট্রেনেরই শতভাগ মিল থাকত না।
এরপর তারা কম্পিউটার সিকোয়েন্স থেকে ভাইরাল জিনোম সংশ্লেষ করতেন। এভাবে এমন এক ভাইরাস জিনোম সৃষ্টি করতেন প্রকৃতিতে যার অস্তিত্ব নেই, তবে দেখতে একদম প্রাকৃতিক ভাইরাসের মতোই লাগত।
গত বছর উহান ইন্সটিটিউট অব ভাইরোলজির বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, তারা চীনের ইউনান প্রদেশের এক গুহায় ২০১৩ সালে বাদুড়ের বিষ্ঠা থেকে রাটিজি১৩ নামে একটি স্ট্রেনের সন্ধান পেয়েছেন। এই স্ট্রেনের সঙ্গে সার্স-কোভ-২-এর ৯৬ দশমিক ১ শতাংশ মিল রয়েছে। এর অর্থ, নতুন করোনাভাইরাসের সিকোয়েন্স তৈরির জন্য রাটিজি১৩ ব্যবহার করা যেত।
২০১৮ সালে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করা হলেও এর প্রায় ১৮ মাস পর, করোনা মহামারি শুরুর কয়েক মাস আগে, ভাইরাল স্ট্রেনের উহান ডাটাবেজ লুকিয়ে ফেলা হয়। এর অর্থ, বিজ্ঞানীদের দলটি কোন ভাইরাস নিয়ে কাজ করছিলেন অথবা কোন ভাইরাস তৈরি করছিলেন, তা জানা অসম্ভব। উহানের বিজ্ঞানীরা অবশ্য বারবারই গবেষণাগারে সার্স-কোভ-২ ভাইরাস তৈরির কথা অস্বীকার করে এসেছেন।
ডব্লিউএইচওর ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, সার্স-কোভ-২ যদি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়ে থাকে, তবে প্রাকৃতিক কোনো ভাইরাসের সঙ্গেই খুব সম্ভব এর মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ বিজ্ঞানীরা এই কাজটিই করার চেষ্টা করে চলেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডব্লিউএইভওর ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিজ্ঞানীরা ভাইরাসটির উৎপত্তির সমস্যা নিয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। একটি কনসোর্টিয়ামের পক্ষে প্রস্তাবটি জমা দিয়েছিলেন ব্রিটিশ প্রাণীবিজ্ঞানী পিটার ডাসজাক।
এর আগে কোভিড-১৯ এর উৎস নিয়ে একটি গবেষণায় দাবি করা হয়, উহানের একটি ল্যাবে চীনা বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাস তৈরি করেছেন। পরে এটি তৈরিতে নিজেদের ভূমিকা গোপন রাখতে রিভার্স-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ভাইরাসটির আরেকটি সংস্করণ তৈরি করা হয়েছে, যাতে মনে হয় এটি বাঁদুড়ে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে।
এই গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেন ব্রিটিশ অধ্যাপক আঙ্গুস ডালগ্লেইশ ও নরওয়ের বিজ্ঞানী বিরজার সোরেনসেন। আঙ্গুস লন্ডনের সেন্ট জর্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকোলজির অধ্যাপক এবং সোরেনসেন ইমিউনর নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি।
২০১৯ সালের শেষের দিকে চীনের শহর উহানে কোভিড-১৯ প্রথম শনাক্ত হয়েছিল। ভাইরাসটির উৎপত্তির জন্য চীনের পশু বিক্রির একটি বাজারের কথা বলা হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাস প্রাণী থেকে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়েছে। শুরু থেকেই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন করোনাভাইরাস তৈরির জন্য চীনকে দায়ী করে আসছে। ট্রাম্পের ক্ষমতা ছাড়ার পর কিছুদিন এই বিতর্ক থেমে গিয়েছিল। কয়েক দিন আবারও সেই বিতর্ক উসকে দেন চীনের এক ভাইরোলজিস্ট। ড. লি মেং ইয়ান নামের এই ভাইরোলজিস্ট দাবি করেন, তার কাছে প্রমাণ রয়েছে যে করোনাভাইরাস চীনের একটি ল্যাবে তৈরি করা হয়েছে। গত বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা করছেন ইয়ান। তিনি জানান, এই বিষয়ে মুখ খোলায় তাকে ক্রমাগত হুমকি দেওয়া হয়। প্রাণ বাঁচাতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে এসেছেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, চীনা বিজ্ঞানীরা একটি প্রাকৃতিক করোনাভাইরাসের মেরুদন্ড পেয়েছেন চীনের গুহার একটি বাদুড়ের দেহে। তারা এটিকে নতুন একটি স্পাইকে যুক্ত করেন। এতে ভাইরাসটি প্রাণঘাতী ও উচ্চ সংক্রমণশীল কোভিড-১৯ এ পরিণত হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩৮
আপনার মতামত জানানঃ