রবিবার রাতে জার্মানির ব্রেমেনে আশ্রয়প্রার্থীদের এক আবাসস্থলে চল্লিশ বছর বয়সি এক সুদানি জার্মান পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। জানা যায় ওই সময়ে যার হাতে ছুরি ছিল।
এ দিন মধ্যরাতের আগে পুলিশকে ফোন করে কেউ একজন আশ্রয়প্রার্থীদের আবাসস্থলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কথা জানায়৷
এক বিবৃতিতে পুলিশ জানিয়েছে, ‘‘পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গেলে চাকু হাতে থাকা এক সুদানির মুখোমুখি হয়।”
পুলিশের অভিযোগ, পরবর্তীতে সেই সুদানি চাকু নিয়ে পুলিশ সদস্যের উপর হামলা করে। এ কারণেই পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র ব্যবহার করেছে এবং বেশ কয়েকটি গুলি করা হয়েছে।
সরকারি কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে৷ সূত্র মতে, ঘটনার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হতে পারে৷ তদন্তে যে বিষয়টির দিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হবে তা হলো, পুলিশ সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছিল কি না।
জার্মানির বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভি জানিয়েছে, সেই রাতে একাধিকবার ঘটনাস্থলে পুলিশ ডাকা হয়েছিল৷ সেই আশ্রয়প্রার্থী রবিবার বেশ কয়েকজনকে হুমকি দিয়েছিলেন বলেও শোনা যাচ্ছে৷
জানা যায়, পুলিশ প্রথমে সেই ব্যক্তিকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে রাজি করাতে চেয়েছিল৷ কিন্তু তিনি তাকে রাজি হননি। এরপর রাত সাড়ে এগারোটার দিকে আবাসস্থলের বাসিন্দারা আবারো পুলিশকে ফোন করে জানায় যে সুদানি ওই আশ্রয়প্রার্থী ছুরি নিয়ে মানুষকে হুমকি দিচ্ছিলেন৷
ব্রেমেনের যে শহরে এই ঘটনা ঘটেছে, সেই হার্সেফেল্ডের মেয়র উটে ক্যুক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে নিহত ব্যক্তির মানসিক সমস্যা ছিল এবং তাকে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং মনোবিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করেছিল৷
আশ্রয়প্রার্থীদের আবাসস্থলের অন্য নয় বাসিন্দা রবিবার রাতের ঘটনায় বেশ মুষড়ে পড়েছেন৷ তাদেরকে আপাতত অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন মেয়র ক্যুক৷
শরণার্থী শিবিরে নির্যাতন
শরণার্থীদের উপর জার্মান পুলিশের নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। ২০১৪ সালে খবরে উঠে এসেছিল জার্মানিতে একটি আশ্রয় কেন্দ্রে শরণার্থী নিপীড়নের ঘটনা৷ কারারক্ষী, সমাজকর্মীসহ মোট ৩০ জনের অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। জার্মানির বুর্বাখের শহরের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।
শরণার্থীদের নিপীড়নে কেন্দ্রটির রক্ষী, পরিচালক ও সমাজকর্মীদের জড়িত থাকার কথা জানা যায়। শরণার্থীদের সাথে ঘটা অন্যায়ের প্রমাণ হিসাবে কিছু ছবি ও ভিডিও সে সময় প্রকাশিত হয়। এমনই একটি ছবিতে দেখা গেছে হাতকড়া পরা অচেতন এক শরণার্থীকে৷ তার গলা পা দিয়ে চেপে আছেন আশ্রয়কেন্দ্রের এক প্রহরী৷ আরেকটি ভিডিওতে এক শরণার্থীকে নোংরা তোশকে জোর করে শোয়াতে দেখা যায়৷ ছবি বা ভিডিওতে দেখা যাওয়া অভিযুক্তদের মধ্যে এক পুলিশকর্মী ছিলেন।
ওই সময় এই ছবিগুলি দেখে পাশের শহর, হাগেনের পুলিশপ্রধান ফ্রাঙ্ক রিখটার এই পরিস্থিতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘গুয়ান্তানামো বে’-র সাথে তুলনা করেন৷ সূত্র মতে,আশ্রয় কেন্দ্রের রক্ষীরা শরণার্থীদের একটি ‘প্রবলেম রুম’-এ বন্দি করে প্রবল মারধরও করতেন৷ জানা যায়, এই মারের কারণ হতো লুকিয়ে ধূমপান করার মতো তুচ্ছ কোনো ‘অপরাধ’৷
এই আশ্রয় কেন্দ্রটি চালানো হতো ‘ইউরোপিয়ান হোম কেয়ার’ সংস্থার তত্ত্বাবধানে৷ এই সংস্থার এক কর্মচারীও শরণার্থীদের সাথে দুর্ব্যবহারের সাথে জড়িত ছিলেন বলে জানা গিয়েছিল৷ সেই ব্যক্তির নির্দেশেই ঠিক হতো কোন শরণার্থীকে নিয়ে যাওয়া হবে ‘প্রবলেম রুম’-এ৷ এরপর বিনা প্রতিবাদে তার সব আদেশ মেনে অত্যাচার চালিয়ে যেতেন আশ্রয় কেন্দ্রের আরেক সমাজকর্মীও৷
আর্ন্সবের্গ শহরের দুই পৌরসভা সদস্যের দিকেও উঠেছিল অভিযোগের আঙুল৷ জানা যায়, এই দুজনের ঘর কুখ্যাত ‘প্রবলেম রুম’-এর ঠিক পাশে ছিল৷ সূত্র মতে, শরণার্থীদের সাথে এমন অপরাধের কথা জানা সত্ত্বেও এ বিষয়ে তারা কিছু করেননি৷’
এদিকে, ২০১৫ সালে জার্মানিতে শরণার্থীদের উপর পুলিশ সদস্যদের নির্যাতনের খবর ব্যাপক সাড়া ফেলে৷ এজন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে অব্যাহতিও দেয়া হয় বলে জানা যায়৷ এ সময় জাতিসংঘ শ্রমবাজারে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ বৃদ্ধি এবং মুসলিম বিরোধী মনোভাব ও আশ্রয়প্রাথীদের উপর হামলা বেড়ে যাওয়ায় জার্মানির সমালোচনা করে৷ জার্মানি থেকে জেনোফোবিয়া দূর করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানায় জাতিসংঘ৷
জানা যায়, এর এক বছর আগে হ্যানোভার রেলস্টেশন থেকে এক আফগান যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ ১৯ বছর বয়সি যুবকটির কাছে পাসপোর্ট বা অন্য কোনো বৈধ কাগজপত্র না থাকায় পুলিশ তার শেকল বাঁধা পা ধরে টেনেহিঁচড়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে নিয়ে যায়৷ এরপর থানায় নিয়ে তাকে পেটানো হয়৷ শুধু তাই নয়, এভাবে নির্যাতন করে আনন্দ পাওয়ার কথা আরেক সহকর্মীকে মেসেজ পাঠিয়ে জানায় নির্যাতনকারী ঐ পুলিশ কর্মকর্তা৷
আরেক ঘটনায়, মরক্কোর এক মুসলিম নাগরিককে নির্যাতন করে জোর করে শূকরের মাংস খাওয়ানোর অভিযোগ ওঠে৷
শিশুদের পরিস্থিতি
এদিকে, ইউনিসেফ বলেছে, জার্মানিতে আসা শরণার্থী শিশুরা জার্মান শিশুদের মতো অধিকার ভোগ করতে পারছে না৷ শরণার্থী শিশুরা জার্মান শিশুদের মতো শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা সুবিধা পাচ্ছে না৷ এছাড়া শিশুদের মধ্যে যাদের জার্মানিতে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম, তারা আরও কম সুবিধা পাচ্ছে।
যেসব শরণার্থী পরিবারের জার্মানিতে থাকার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম সেই পরিবারগুলোর শিশুরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলেও জানিয়েছে ইউনিসেফ৷
ইউনিসেফ বলছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছানো পরিবার-পরিজন বিহীন শিশুর সংখ্যা চলতি বছর দ্বিগুণ হয়েছে৷
সূত্র মতে, শরণার্থী শিশুদের মধ্যে অনেককে জার্মানি পর্যন্ত আসতে ভয়াবহ ও নৃশংস অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয়েছে৷ তাদের জন্য বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন৷
এসডব্লিউ/এসএস/১১৫৭
আপনার মতামত জানানঃ