লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ব্রাজিলে। দেশটির ডানপন্থি প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর একগুঁয়েমির কারণে করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি দেশটির স্বাস্থ্য খাত। একদিকে করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ; অন্যদিকে খাদ্যাভাব, বেকারত্ব, মন্দায় নাকাল ব্রাজিলবাসী। মহামারীতে গত বছর ব্রাজিলের অসংখ্য মানুষকে খাদ্যাভাবে ভুগতে হয়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণাতেও খাদ্য অনিশ্চয়তার বিষয়টি উঠেও এসেছে।
আর এই বিভৎসতা উঠে এসেছে বিখ্যাত চিত্রসাংবাদিক ডমিংগোস পিক্সোটোর ক্যামেরায়। বহুদিনের পুরনো হাড়-মাংসের স্তূপের মধ্যে খাবার খুঁজছেন একজন শীর্ণকায় মানুষ। মাংস যা ছিল, তাও পচে গলে গিয়েছে। তবু সেটুকুই যদি সংগ্রহ করা যায়, তাহলে খানিকটা খিদে মিটতে পারে। হ্যাঁ, এমনই ভয়ানক ছবি উঠে এসেছে ব্রাজিলের রাজধানী রিও শহর থেকে।
ইতিমধ্যে সারা পৃথিবীতে চাঞ্চল্য ফেলে দিয়েছে এই ছবি। এমনকি নানা দেশ থেকে সাংবাদিকরা ছুটেছেন বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য। করোনা অতিমারী ও তার কারণে আর্থিক মন্দা পরিস্থিতিতে ব্রাজিলের বহু মানুষই অনাহারে অথবা অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন, এমন কথা শোনা যাচ্ছিল বেশ কয়েক মাস ধরেই। কিন্তু তার ছবিটা যে এমন মর্মঘাতী হতে পারে, সেটা কল্পনা করেননি অনেকেই।
সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কোভিডের কারণে ব্রাজিলে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ লক্ষ মানুষ। আর অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন ১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ। দিনের এক বেলা একমুঠো খাবারের সংস্থানও নেই তাদের। শুধু তাই নয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্রাজিলের ৭৭ শতাংশ মানুষই দারিদ্রসীমার নিচে নেমে এসেছেন।
বলা বাহুল্য, এই পরিসংখ্যানের পুরোটাই সরকারি তথ্যের উপর নির্ভর করে। বাস্তবে সংখ্যাটা আরও বেশি বলেই মত অনেকের। তবু এই পরিস্থিতিতেও থমকে নেই বহুজাতিক সংস্থাগুলির ব্যবসা। ব্রাজিলের ধনীরাও আরও ধনী হয়ে উঠছেন। তাই টান পড়েনি সুপার-মার্কেটগুলির বিক্রিবাটায়। সুপার-মার্কেটগুলি থেকে মাংস বিক্রির পর অবশিষ্ট হাড়গোড় পৌঁছে যাচ্ছে পোষ্য প্রাণীর খাবার এবং সাবান তৈরির কারখানায়। তবে সবটা পৌঁছচ্ছে না। রাস্তায় সেই হাড় এবং পচাগলা মাংসের ছিটেফোটা চুরি করে নিচ্ছেন খিদে পাওয়া মানুষ।
ব্রাজিলের একটি প্রথম সারির দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে এমনই এক ট্রাক চালকের জবানবন্দি। প্রতিদিন সুপার-মার্কেট থেকে মাংসের হাড় কারখানায় নিয়ে যান তিনি। এর আগেও বহুবার তার গাড়ি আটকে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষ। প্যাকেটজাত খাবার তারা পোষ্য প্রাণীদের খাওয়াতে পারেন না। তাই সামান্য কিছু অর্থ দিয়ে হাড়গোড় কিনে নিতেন তারা। কিন্তু এবারের দৃশ্য সম্পূর্ণ অন্যরকম। পোষ্য প্রাণীর জন্য নয়, বরং মানুষ উচ্ছিষ্ট হাড়ের টুকরো খুঁজছেন নিজের জন্য বা নিজের ছেলেমেয়ের জন্য। আর তার মধ্যে একটুকরো মাংস লেগে থাকলে তো আলাদা প্রাপ্তি।
প্রথমদিন এমন ঘটনার সামনে পড়ার পর রাত্রে ঘুমাতে পারেননি সেই ট্রাকচালক। অবশ্য এখন এটাই তার দৈনন্দিন কাজ হয়ে গিয়েছে। তার গাড়ি আসার খবরও জেনে গিয়েছেন এলাকার মানুষরা। সেই সময় লাইন দিয়ে জড়ো হন সবাই। যাওয়ার আগে ঈশ্বরের নামে আশীর্বাদ করে যান সেই ট্রাকচালককে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এক বছরে ব্রাজিলে চালের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। যেখানে ব্ল্যাক বিন, আলু, মাংস, দুধ এবং সয়াবিন তেলের দাম বড়েছে যথাক্রমে ৫১, ৪৭, ৩০, ২০ এবং ৮৭ শতাংশ। এছাড়া ব্রাজিলে বহুল ব্যবহৃত বোতলের গ্যাসের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ।
এ অবস্থায় দরিদ্রদের সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ নেরি বলেন, ‘দরিদ্ররা সহায়তার জন্য বন্ধু-স্বজনদের দারস্থ হচ্ছেন। সবকিছু তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।’
এ অবস্থায় অসংখ্য মানুষকে সরকারি ও বিত্তশালী প্রতিবেশীদের সহায়তায় চলতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়তে থাকায় অনেককেই সহায়তার আশ্রয় নিতে হচ্ছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত নাগরিকদের অনকেকে শুধুমাত্র সহায়তার ওপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছে। এ অবস্থায় কতদিন চলতে হবে সেই আশঙ্কাও ভর করছে তাদের মধ্যে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অধিক মাত্রার বেকারত্ব, সামাজিক অনুষ্ঠানাদি কমে যাওয়া এবং খাবারের দাম বৃদ্ধি এই সমস্যার কারণ। গবেষণার সমন্বয়কারী ব্রাজিলের পুষ্টি সুরক্ষা গবেষণা নেটওয়ার্কের প্রেসিডেন্ট রেনাতো মালুফ বলেন, ‘এটি দুঃখজনক ঘটনা, যা অনুমিতই ছিল। পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।’
কংগ্রেসম্যান এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আলেসান্দ্রো পাদিলহা বলেন, ‘করোনাকালে ক্রমবর্ধমান ক্ষুধা ও খাদ্য অনিশ্চয়তা বেশ উদ্বেগজনক। এই অবস্থায় কাজের সন্ধানে যেতে বাধ্য হওয়ায় মানুষ সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়ছেন। এসব মানুষ পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়ায় তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং তারাই করোনার বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। একদিকে ক্ষুধা, অন্যদিকে করোনাভাইরাস, এটি একটি করুণ সমন্বয় যা ব্রাজিলকে ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’
দীর্ঘদিন ধরেই ব্রাজিলের বলসোনারো সরকারের বিরুদ্ধে নানারকম অভিযোগ উঠছিল। সেই অভিযোগই যেন আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল এই ছবিকে ঘিরে। বিরোধীরাও যেন আরেকটা অস্ত্র পেয়ে গেলেন হাতে। তবে এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্যে সাধারণ মানুষ কি বেঁচে থাকার নূন্যতম সুবিধাটুকু পাবেন?
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ