দেশে ধূমপান ও তামাক সেবনের কারণে বছরে ১২ লাখ মানুষ আটটি প্রাণঘাতী অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায়।
তামাকজাত দ্রব্যের অতিরিক্ত ব্যবহার হৃদরোগ, ক্যান্সার, বক্ষব্যাধি এবং অন্যান্য অনেক প্রতিরোধযোগ্য রোগ এবং মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।
তামাকের কারণে পৃথিবীতে প্রতি বছর ৭০ লাখের বেশি মানুষ অকালে মারা যায়। এর মধ্যে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে বছরে ৯ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, হৃদরোগের কারণে মৃত্যুর ৩০ শতাংশ, ক্যানসারে মৃত্যুর ৩৮ শতাংশ, যক্ষ্মায় মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগের মৃত্যুর হার ২০ শতাংশের জন্য ধূমপান দায়ী।
এমনকি তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৪৮ শতাংশ, যেখানে অতি উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠির মধ্যে এই হার মাত্র ২৪ শতাংশ।
দেশে তামাকের ভয়াবহতা অত্যন্ত ব্যাপক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৪ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ধূমপান ও তামাক সেবনের কারণে ১২ লাখ মানুষ আটটি প্রাণঘাতী অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়, এর মধ্যে তিন লাখ ৮২ হাজার মানুষ অকাল পঙ্গুত্বের শিকার হয়।
টোব্যাকো এটলাস নামের আন্তর্জাতিক এক প্রকাশনায় দেখা গেছে, দেশে এক লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যায়।
করোনা মহামারির এই সময়ে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে কঠোরভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এজন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে শক্তিশালী করতে এর ছয়টি ধারা সংশোধন করা জরুরি।
গত বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ফারস হোটেলে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন।
বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টারস ফোরাম, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো-ফ্রি কিডস এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের সহযোগিতায় আলোচনা সভাটি আয়োজন করে।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর ডা. আহমদ খাইরুল আবরার।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ৩.৭৮ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক তামাক ব্যবহার করে। কর্মক্ষেত্র ও গণপরিবহনসহ বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় আরও ৩৮.৪ মিলিয়ন মানুষ। তাছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ আক্রান্তদের তুলনায় ধূমপায়ীদের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা ১৪ গুণ বেশি।
অনুষ্ঠানে বক্তারা মত দেন, তামাকের ক্ষতির হাত থেকে জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
এদিকে ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো-ফ্রি কিডসের লিড পলিসি অ্যাডভাইজর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “দেশে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিভিন্ন দিক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তামাক নিয়ন্ত্রণের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কিন্তু তারপরও আইনটির কিছু জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে। এই দুর্বলতাগুলো সংশোধন করা হলে, আইনটি আরো কার্যকর হবে।”
সভায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীর দাবি জানান বক্তারা। এগুলো হলো মহামারির সময়ে সব ধরনের পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনকে শতভাগ তামাকমুক্ত করা, দোকানপাটে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানিসমূহের কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, ই-সিগারেট আমদানি, উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে মুদ্রিত স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার বৃদ্ধি করা এবং সিগারেটের সিংগেল স্টিক তথা খুচরা বিক্রি নিষিদ্ধ করা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তামাক ছাড়ার সুফল অনেক। যদি কোনো ব্যক্তি টানা ১ বছর তামাকমুক্ত থাকতে পারেন তবে, তার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ধূমপায়ীর তুলনায় অর্ধেক কমে যায় এবং ধূমপান ছাড়ার ১০ বছরের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি অর্ধেকে নেমে আসে। এছাড়া ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে তামাক ছাড়লে প্রত্যাশিত আয়ু তামাক ব্যবহারকারীর তুলনায় প্রায় ১০ বছর বেড়ে যায়।
তারা আরও বলছেন, শ্বাসতন্ত্র এবং হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। তামাক ব্যবহারে করোনারি হার্ট ডিজিজ এবং স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি ২ থেকে ৪ গুণ বেড়ে যায় এবং মুখ গহ্বর, ফুসফুস, খাদ্যনালিসহ প্রায় ২০ ধরনের ক্যানসার হয়। অধূমপায়ীর তুলনায় ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে ২৫ গুণ। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুস সংক্রমণে (সিওপিডি) ধূমপায়ীদের মৃত্যুঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় ১৩ গুণ পর্যন্ত বেশি।
সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারিতে ধূমপায়ীদের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে ৪ কোটি ৮ লাখ মানুষ এবং এক্ষেত্রে নারীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় ঢাকার প্রাথমিক স্কুলে পড়া ৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে উচ্চমাত্রার নিকোটিন পাওয়া গেছে, এর মূল কারণ পরোক্ষ ধূমপান।
গ্যাটস ফলাফলে আরও দেখা গেছে, ২০০৯ সালের তুলনায় একজন বিড়ি সেবনকারীর বিড়ি বাবদ মাসিক খরচ বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে সিগারেট কিনতে একজন ধূমপায়ীর গড় মাসিক ব্যয় হয় ১০৭৭ দশমিক ৭ টাকা। অথচ শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য একটি পরিবারের মাসিক গড় ব্যয় যথাক্রমে মাত্র ৮৩৫ দশমিক ৭ টাকা।
তামাকের জন্য ব্যয়িত অর্থ শিক্ষা ও চিকিৎসা দারিদ্র্য তথা মানবদারিদ্র্য মোকাবিলায় ব্যয় করা গেলে পরিবারগুলোর জীবনমানে উন্নতি ঘটানো সম্ভব।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৩৫
আপনার মতামত জানানঃ