অদ্ভুত শোনালেও ঢাকায় মোট সড়কের ৭০ ভাগ জায়গা দখলে রাখছে মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি। অথচ ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ মানুষ। এসব গাড়িতে চলাচল করেন মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ।
বাকি ৯৩ শতাংশ মানুষ চলাচল করেন বাস, রেল, নৌপথ, রিকশা ও হেঁটে। কিন্তু এ মাধ্যমগুলোর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে না। ফলে শহরে বাড়ছে যানজট আর দূষণ।
গতকাল শনিবার সকালে ‘বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবসে নগর পরিকল্পনায় আমাদের ভাবনা’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
বক্তারা জানান, যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যানজট কমাতে গত ১০ বছরে সরকার খরচ করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তাতে সুফল মেলেনি।
উল্টো যানজট আর দূষণ বেড়েছে বহুগুণ। গাড়ির দীর্ঘ যানজটের কারণে ঢাকার রাস্তায় গেল ১০ বছরে ঘণ্টায় ৭ কিলোমিটার গতি কমেছে। এ জন্য ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বক্তারা বলেন, দূষণ থেকে মুক্তি পেতে ব্যক্তিগত গাড়ির লাগাম টানতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে হাঁটাবান্ধব পরিবেশ ও আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা। ঢাকার রাস্তায় সাধারণ মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
এই অবস্থায় নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যক্তিগত গাড়ি কমিয়ে হাঁটাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এ ছাড়া নগর-পরিকল্পনায় শিশু, নারী, বয়স্ক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের গুরুত্ব দিয়ে হাঁটার জন্য ফুটপাত ও আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবীইং বাংলাদেশ, কারফ্রি সিটিস এলাইন্স, কারফ্রি সিটিস এলাইন্স বাংলাদেশ এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট যৌথভাবে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
ওয়ার্ক ফর অ্যা বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারীর সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য দেন হেলফ ব্রিজ ফাউন্ডেশন অব কানাডার আঞ্চলিক পরিচালক ডেবরা এফ্রয়েমসন, স্থপতি খন্দকার এম আনসার হোসেন, নাসফ-এর সভাপতি হাফিজুর রহমান ময়নাসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ঢাকাবাসীর নিত্যদিনের দুর্ভোগের নাম যানজট। এই যানজটের কারণে অতিষ্ঠ শুধু সাধারণ মানুষের জীবন নয়, প্রতিনিয়ত শূন্য হচ্ছে রাষ্ট্রের পকেটও। নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘণ্টা। পাশাপাশি যানজটে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় তৈরি হয় মানসিক অবসাদ।
যানজট নিয়ে সর্বশেষ গবেষণা বলছে, ঢাকায় যানজটের কারণে পিক আওয়ারে গণপরিবহনগুলোর গতিবেগ ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে, যেখানে হেঁটে চলার গড় গতিও ৫ কিলোমিটার। ফলে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ১২ বছর আগেও এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার।
এআরআই’র গবেষণায় বলা হয়, ২০১৫ সালের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) অনুযায়ী, ঢাকায় দৈনিক প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ ট্রিপ হয়। উল্লেখ্য, একজন মানুষ কোনও একটি বাহনে উঠে নির্ধারিত গন্তব্যে নামলে একটি যাত্রা বা ট্রিপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা গড়ে ছিল ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। ২০০৯ সালে তা ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটারে এসে দাঁড়ায়। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনও উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।
এদিকে, ২০১১ সালে রাজধানীতে যানজটের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি) জানায়, ক্ষতির পরিমাণ বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা। ২০১২ সালে যানজটের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করে ইউএনডিপি। তাতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ হাজার কোটি টাকার মতো। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড (বিওআই) জানায়, রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার, যা মোট জিডিপির ৭ শতাংশের সমান।
২০১৬ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘নগর পরিস্থিতি-২০১৬: ঢাকা মহানগরে যানজট, শাসন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, যানজটের আর্থিক ক্ষতির পরিমাপে ২৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘের এয়ারপোর্ট-পোস্তগোলা রুটকে নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়।
দেখা গেছে, ব্যস্ত সময়ে (পিক আওয়ার) এ রুটে গাড়ির গতিসীমা থাকে ঘণ্টায় ৯ কিলোমিটার। এই ধীরগতির কারণে প্রতিবার যাতায়াতে একজন যাত্রীর যে সময় নষ্ট হয়, যার আর্থিক পরিমাণ দিনে আনুমানিক ৫৩ টাকা। এ ছাড়া যানজটে নষ্ট হওয়া সময়ের আর্থিক মূল্য ও জ্বালানি খরচ সার্বিকভাবে মাসে ২২৭ কোটি টাকা দাঁড়ায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সর্বশেষ ২০১৮ সালে ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট: আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই)। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যানজটের কারণে ২০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক ক্ষতি হচ্ছে।
এ থেকে বলা যায়, যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে গড়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। তবে সড়ক খাতে বিনিয়োগ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও যানজট নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই ক্ষতি অন্তত ৬০ শতাংশ বা ২২ হাজার কোটি টাকা কমানো যেত।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১২১৪
আপনার মতামত জানানঃ