দেশের তৈরি পোশাক খাতের ৮৪ শতাংশ শ্রমিক করোনার বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। ১৬ শতাংশ শ্রমিকের আশঙ্কা, আগামী দিনে তাদের মজুরি কমে যাবে। যদিও ৬৩ শতাংশ শ্রমিকের ধারণা, তারা এখনকার মতো একই ধরনের মজুরি পাবেন। আর ১৯ শতাংশ শ্রমিক ভবিষ্যতে কী পরিমাণ মজুরি পাবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও মাইক্রোফাইন্যান্স অপরচুনিটিসের (এমএফও) যৌথভাবে পরিচালিত ‘গার্মেন্টস ওয়ার্কার ডায়েরিজ’ শীর্ষক ধারাবাহিক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। আজ মঙ্গলবার জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়েছে।
সানেম ও এমএফও গত বছরের এপ্রিল থেকে প্রতি মাসে চট্টগ্রাম, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের পোশাকশ্রমিকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছে। গত ৬ আগস্ট ১ হাজার ২৭৮ জন শ্রমিক মুঠোফোনে পরিচালিত জরিপে অংশ নেন। তার মধ্যে তিন-চতুর্থাংশের বেশি নারী শ্রমিক। এ জরিপে পোশাকশ্রমিকদের মাঝে কভিড-১৯-এর কারণে ঘোষিত লকডাউনের প্রভাব এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বর্তমান অবস্থা ও আগামীতে মজুরি হ্রাস-বৃদ্ধির সম্ভাবনার ব্যাপারে তাদের মনোভাবের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ, আয়, ব্যয়, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও মজুরি প্রদান ব্যবস্থার ডিজিটাইজেশন ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে জরিপটি পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠান দুটি।
এ জরিপের মূল লক্ষ্য হচ্ছে নিয়মিত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে তথ্যভিত্তিক নীতিগ্রহণ ও বৈশ্বিক ব্যান্ডগুলোকে শ্রমিকমুখী উদ্যোগ নিতে সহায়তা করা, যা পোশাকশ্রমিকদের জীবনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় এবং তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ওপর কভিড-১৯-এর প্রভাব আরও ভালোভাবে বুঝতে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষকে সহায়তার ক্ষেত্রেও এ জরিপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
করোনার সংক্রমণ রোধে ঈদুল আজহার পর কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হয়। তার মধ্যে ১ আগস্ট থেকে রপ্তানিমুখী কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তখন গণপরিবহন বন্ধ থাকলে শ্রমিকেরা কর্মস্থলে ফিরতে দুর্ভোগের শিকার হন। পরে শ্রমিকদের যাতায়াতের জন্য সীমিত সময়ের জন্য বাস ও লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার।
জরিপে পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে করোনার কারণে ঘোষিত লকডাউনের প্রভাব এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বর্তমান অবস্থা ও আগামীতে বেতন বাড়া-কমার সম্ভাবনার ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে রফতানিমুখী শিল্পের জন্য লকডাউন শিথিল করার সিদ্ধান্ত আসার পর পোশাক শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়। চলতি বছরের ৬ আগস্ট পরিচালিত এ জরিপে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের কাছে লকডাউনের সময় কাজে ফেরার নির্দেশের ব্যাপারে তাদের মনোভাব জানতে চাওয়া হয়। ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা জানান, তারা বাংলাদেশে করোনার বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি চালু হওয়ার পর প্রথম সপ্তাহে শ্রমিকদের উপস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম ছিল।
৬ আগস্ট ৮৩ শতাংশ শ্রমিক বলেন, তারা এর আগের সপ্তাহে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। পুরুষদের তুলনায় নারী শ্রমিকদের উপস্থিতি কিছুটা কম ছিল। প্রথম সপ্তাহে ৮৯ শতাংশ পুরুষ ও ৮১ শতাংশ নারী শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। কাজে উপস্থিত থাকা ৮৩ শতাংশ উত্তরদাতার মধ্যে ৪৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা লকডাউনের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে অসুবিধা বোধ করেননি।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে কাজে উপস্থিত থাকা পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের কাজের সময় পরার জন্য মাস্ক দেওয়া হয়েছিল। তবে কাজের সময় কারখানায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে পেরেছেন কি না জানতে চাইলে তুলনামূলক ইতিবাচক চিত্র পাওয়া যায়। কাজে যোগ দেওয়া উত্তরদাতাদের মাঝে ৭৭ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা কাজের সময় কারখানায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে পেরেছেন।
মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা বাদে অন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪৭ শতাংশ পোশাক শ্রমিক জানান, তাদের কারখানায় করোনা সংক্রমণ রোধে অতিরিক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই ৪৭ শতাংশের মধ্যে ৮৩ শতাংশ মনে করেন, অতিরিক্ত পদক্ষেপগুলো সংক্রমণ রোধে যথেষ্ট ছিল।
আগামীতে কি পরিমাণ মজুরি পাবেন বলে ধারণা করেন জানতে চাইলে ৬৩ শতাংশ উত্তরদাতা জানান, তারা প্রায় একই ধরনের মজুরি পাবেন বলে প্রত্যাশা করেন। ১৯ শতাংশ জানান তারা এ ব্যাপারে অনিশ্চিত। ১৬ শতাংশ উত্তরদাতা জানান তারা স্বাভাবিকের চেয়ে কম মজুরি পাবেন বলে ধারণা করছেন।
আগামীতে কি পরিমাণ মজুরি পাবেন বলে ধারণা করেন জানতে চাইলে ৬৩ শতাংশ উত্তরদাতা জানান, তারা প্রায় একই ধরনের মজুরি পাবেন বলে প্রত্যাশা করেন। ১৯ শতাংশ জানান তারা এ ব্যাপারে অনিশ্চিত। ১৬ শতাংশ উত্তরদাতা জানান তারা স্বাভাবিকের চেয়ে কম মজুরি পাবেন বলে ধারণা করছেন।
১ শতাংশ উত্তরদাতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মজুরি পাওয়ার প্রত্যাশা করেন, যাদের মধ্যে প্রায় সবাই ওভারটাইম কাজ করেছেন।
জরিপে উঠে আসে, পোশাকশ্রমিকরা তাদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ নিয়ে নিরাপদ বোধ করছেন না এবং কারখানার মালিকরা তাদের উদ্বেগ কমাতে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেননি। শ্রমিকদের তাদের ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে, শ্রমিকদের উদ্বেগ নিরসনে ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নিতে হবে। তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদন, রপ্তানি ও সামগ্রিকভাবে পুরো অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কারখানার মালিকপক্ষ, সরকার, নীতিনির্ধারক ও অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলোকে সম্মিলিতভাবে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে বলে মনে করে সানেম।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আধুনিক বিশ্বের পুঁজিবাদী রাষ্ট্র দর্শনের কোনটাই শ্রমিকের প্রকৃত অধিকার ও মর্যাদার ন্যূনতম সমাধান দিতে পারেনি। ফলে এখনও শ্রমিক-মজুররা নিষ্পেষিত হচ্ছে। মালিকের অসদাচরণ, কম শ্রমমূল্য প্রদান, অনপযুক্ত কর্ম পরিবেশ প্রদানসহ নানা বৈষম্য শ্রমিকের দুর্দশা ও মানবেতর জীবনযাপনের কারণ হয়ে আছে।
আমাদের এই অনুন্নত দেশের জন্য, উন্নত সভ্যতার জন্য শিল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এটি শুধু মালিকপক্ষ আর শ্রমিকপক্ষের দ্বন্দ্ব নয়, এটাকে জাতীয় ইস্যু হিসেবে নিয়ে শ্রমিকদের পক্ষে আমাদের জোর দাবি তুলতে হবে। তাই আমাদের প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার যেন সমুন্নত থাকে সেই প্রচেষ্টা করতে হবে। সকল বৈষম্য দূর করে শ্রমজীবী মানুষের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২১
আপনার মতামত জানানঃ