বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে বিক্ষোভ দমনে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। বন্ধ হওয়া পোশাক কারখানাগুলো খুললে যে শ্রমিকেরা কাজে যোগ দেবেন না, তাদের মজুরি দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন সাবেক বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান।
তৈরি পোশাক খাতে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকরা গত এক সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ করছেন। বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলিও ছুঁড়েছে। মারা গেছেন দুই জন। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় এরই মধ্যে মিরপুর, আশুলিয়া ও গাজীপুরে দুইশরও বেশি কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকরা।
সিদ্দিকুর রাহমান বলেন, ‘এভাবে পোশাক কারখানায় হামলা হলে রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে। গত মাসে রপ্তানি ১৪ শতাংশ কম হয়েছে। আমরা তো বলেছি, শ্রমিকদের বেতন বাড়বে। ডিসেম্বর থেকে শ্রমিকরা সেই বর্ধিত বেতন পাবেন। তারপও কী কারণে বিক্ষোভ হচ্ছে বুঝতে পারছি না।’
ন্যূনতম মজুরি বোর্ড যথা সময়ে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির কাজ শেষ না করতে পারেনি। ছয় মাসের জন্য গঠিত এই বোর্ডের মেয়াদ গত ৮ অক্টোবর শেষ হলেও তারা আবার সময় বাড়িয়ে নেয়। অন্য দিকে বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার ৯৯৩ টাকা প্রস্তাব করলেও মালিক পক্ষ প্রস্তাব করে ১০ হাজার ৪০০ টাকা। এই কারণেও শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়।
গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ইউনিটি কাউন্সিলের সভাপতি মো. তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘শ্রমিকরা এখন যে মজুরি পান, তাতে তাদের ১৫ দিনও চলে না। বোর্ডে মালিকপক্ষ ১০ হাজার টাকা ন্যূনতম বেতনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এটা হাস্যকর। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ন্যূনতম বেতন করা হয় আট হাজার টাকা বা ৯৫.৫ ডলার। এখন ডলারের যা রেট তাতে ওই ৯৫.৫ ডলারে আসে ১০ হাজার ৫৩৯ টাকা (১ ডলার=১১০.৫ টাকা)। তাহলে মালিকরা যদি ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার টাকার প্রস্তাব দেন, তাতে তো বেতন বাড়ে না, উল্টো কমে। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব হচ্ছে ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা।’
তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বর থেকে নতুন মজুরি কার্যকর হওয়ার কথা। আমরা গত মে মাসেই বলেছিলাম, যখন থেকেই কার্যকর হোক নতুন মজুরি যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঘোষণা করা হয়। সেটা না করে তারা সময় আরও বাড়িয়ে নেয়। ধারণা করি, মালিক পক্ষের অসহযোগিতার কারণে এটা হয়েছে। এটা শ্রমিকদের মধ্যে সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।’
‘এখন যে শ্রমিক বিক্ষোভ হচ্ছে, সেটা কোনো ট্রেড ইউনিয়নের কর্মসূচির ভিত্তিতে নয়। এটা শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ। তবে সন্দেহ করি, এর মধ্য থেকে কেউ কেউ হয়তোবা রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে,’ বলেন এই শ্রমিক নেতা।
বোর্ডে শ্রমিকদের প্রতিনিধি বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ‘আমরা সব দিক বিবেচনা করে বোর্ডে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে নূনতম মজুরি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা প্রস্তাব করেছি। মালিকপক্ষ প্রস্তাব করেছে ১০ হাজার ৪০০ টাকা। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা দেয়া হবে। দুই পক্ষের প্রস্তাব নিয়ে এখন দর কষাকষি হয়ে ন্যূনতম বেতন নির্ধারিত হবে। যদি এখানে সমাধান না হয়, তাহলে সরকারের কাছে চলে যাবে। সরকার ঠিক করে দেবে। এখানে অবিশ্বাস আর সন্দেহের কিছু নেই। আমার ধারণা, এটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
বোর্ডে মালিক পক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে আছেন বিজিএমইএ-র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘শ্রমিকরা ২০ হাজার টাকা প্রস্তাব করেছেন। আমরা ১০ হাজার টাকা প্রস্তাব করেছি। এখন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যা ঠিক হয়, তাই হবে। আমরা ঠিক করতে না পারলে সরকার ঠিক করে দেবে। আইনে তা-ই বলা আছে।’
তার কথা, ‘আমরা তো বলেছি, ডিসেম্বর থেকে তাদের নতুন মজুরি কার্যকর হবে। এই মাসেই তাদের নতুন মজুরি ঘোষণা করা হবে। আমরা তো নিয়মের বাইরে কিছু করছি না।’
‘সবার কাছে আমাদের আহ্বান থাকবে-একটি উইন উইন অবস্থায় মজুরি নির্ধারণ হবে। এটা নিয়ে কেউ যেন অস্থিরতা তৈরি না করেন,’ বলেন সিদ্দিকুর রহমান।
তিনি বলেন, মিরপুর, আশুলিয়া ও গাজীপুরে ২৫০টির মতো কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বিক্ষোভে ক্ষতির আশঙ্কায়। বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানায় আগুন দেওয়া হয়েছে, ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে ক্রেতাদের কাছে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে। গত মাসে পোশাক রপ্তানি ১৪ শতাংশ কম হয়েছে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে রপ্তানি আরও কমে যাবে। এখান থেকে অর্ডার চলে যাবে। ২০১৩-১৪ সালেও এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘শনিবার থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়া পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হবে। শিল্প পুলিশ, র্যাব কারখানার নিরাপত্তা দেবে। আর যে শ্রমিকরা কাজে যাবে না তারা আইন অনুযায়ী কোনো মজুরিও পাবেন না।’
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন। রপ্তানি আয়ের ৮২ ভাগেরও বেশি আসে এই খাত থেকে।
আপনার মতামত জানানঃ