একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বৈদেশিক ঋণের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। গত ছয় বছরে দেশে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে দ্বিগুণের কাছাকাছিতে দাঁড়িয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। এ অবস্থায় বৈদেশিক ঋণের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিতের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ পরিহার করে চলা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যথায় তা দেশের জন্য বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
বৈদেশিক ঋণের ফাঁদ
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালের জুন শেষে দেশে বৈদেশিক ঋণের স্থিতির পরিমাণ ছিল ৩৭ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার (১ বিলিয়ন = ১০০ কোটি)। সেখান থেকে বাড়তে বাড়তে চলতি বছরের মার্চে এসে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭২ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারে। সে হিসাবে গত ছয় বছরে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়েছে প্রায় ৯৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
একই সঙ্গে বাড়ছে বৈদেশিক ঋণ-রফতানি অনুপাতও। ২০১৫ সালে রফতানির বিপরীতে বৈদেশিক ঋণ ছিল ১১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯১ দশমিক ২ শতাংশে। অর্থাৎ রফতানির তুলনায় বৈদেশিক ঋণ এখন অনেক বেশি। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণ ও চলতি হিসাবের অনুপাতও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৫ সালে চলতি হিসাবের তুলনায় বৈদেশিক ঋণ ছিল মাত্র ৭৪ দশমিক ৮ শতাংশ, যা গত বছর উন্নীত হয়েছে ১১১ শতাংশে।
বর্তমানে বেশকিছু বৈদেশিক ঋণনির্ভর বড় উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা) দিয়েছে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে জি-টু-জির মাধ্যমে ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে চীন।
এছাড়া ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল (উত্তরা-মতিঝিল, এআরটি লাইন-৬) প্রকল্পে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে জাইকা। এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে ১১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এডিবি। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন।
এই পরিস্থিতিতে দ্বিপক্ষীয় ঋণের পরিমাণ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে দ্বিপক্ষীয় দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ১ হাজার ৭৭১ কোটি ৭১ লাখ ডলারের বেশি। এর মধ্যে সরকারের ঋণ ১ হাজার ৭৫১ কোটি ৪৩ লাখ ডলার ও বেসরকারি খাতে ২০ কোটি ২৮ লাখ ডলার।
বর্তমানে দেশে রাশিয়া, চীন ও ভারতের বড় ধরনের ঋণ প্রস্তাব রয়েছে। এগুলো গৃহীত হলে সামনের দিনগুলোয় দ্বিপক্ষীয় ও মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ আরো বাড়বে। এর মধ্যে চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ঋণের প্রস্তাব প্রতি বছরই বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের আইডিএ ঋণসহায়তাও আরো বাড়তে পারে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাও এখন ঋণ নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
২০১৫ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৭৬ ডলারে। ঋণ গ্রহণে জটিলতা ও বিভিন্ন সারচার্জ এবং অবকাঠামো সমস্যার কারণে বেসরকারি উদ্যোক্তারা এখন বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
মাথাপিছু ঋণ
বেড়েই চলছে বৈদেশিক ঋণের বোঝা। দেশের প্রতিটি মানুষের ঘাড়ে এই মুহূর্তে (গত জুন পর্যন্ত) ২৩ হাজার ৪২৫ টাকা ৫২ পয়সা করে বৈদশিক ঋণ রয়েছে। আজ যে শিশু জন্মগ্রহণ করবে, ওর মাথায়ও এই ঋণের বোঝা চাপবে। এদিকে দিনে দিনে কমছে সহজ শর্তের বা স্বল্পসুদের ঋণ। ইতোমধ্যে ঋণের সুদ ও শর্ত বাড়িয়েছে উন্নয়নসহযোগীরা।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশ থেকে নেয়া ঋণের অর্থ সঠিক এবং প্রয়োজনীয় প্রকল্পে ব্যয় করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, চড়া সুদসহ বিভিন্ন কঠিন শর্তে ঋণ নিয়েও প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে সরকার। কিন্তু সেই টাকার যদি কার্যকর ব্যবহার না হয় কিংবা রিটার্ন ঠিকমতো না আসে, তাহলে সাধারণ মানুষের ঘামের টাকায় পরিশোধ করা এই ঋণের প্রকৃত উদ্দেশ্য ভেস্তে যেতে পারে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ‘ফ্লো অব এক্সটার্নাল রিসোর্স ইন টু বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে (গত জুন পর্যন্ত) বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি রয়েছে ৪ হাজার ৪০৯ কোটি ৫১ লাখ মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে) দাঁড়ায় ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৮৯৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এ হিসাবে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ধরে হিসাব করলে প্রত্যেকের মাথায় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা।
এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুন পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৩ হাজার ৮৪৭ কোটি ৫৪ লাখ ডলার এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৩ হাজার ৩৫১ কোটি ১৮ লাখ ডলার।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিমাত্রায় বিদেশী ঋণ বৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি বয়ে আনবে। এ ঋণ মাত্রা ছাড়ালে চাপ পড়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হারের ওপর। বাংলাদেশে এখন বিনিয়োগ চাহিদা বাড়ছে। আর এর সঙ্গে বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদাও। বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণের সুদসহ আসল পরিশোধ করতে গিয়ে ভবিষ্যতে এ চাহিদা মারাত্মক চাপে রূপ নেয়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে।
সেক্ষেত্রে বাড়তি চাহিদার কারণে ডলারের বিনিময় হারও বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে বৈদেশিক ঋণের প্রকৃত সুদও। বিদেশী ঋণের সঠিক ব্যবহার না হলে এ দায় আরো দীর্ঘ হবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরো দায়গ্রস্ত করে তুলবে। অন্যদিকে ভবিষ্যতে যেকোনো বৈশ্বিক মন্দার ক্ষেত্রে বিদেশীরা দ্রুত এ ঋণ তুলে নিতে চাইবে। এছাড়া বর্তমানে কম সুদে ঋণ পাওয়া গেলেও এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সে সুযোগ কমে আসবে।
এলডিসিভুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ এখন সর্বোচ্চ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে বিশ্বব্যাংকের আইডিএ ঋণ পাচ্ছে। কিন্তু সামনের দিনগুলোয় সাধারণ হারে ঋণ নিতে হতে পারে। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ; বিশেষ করে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো ও রফতানি বহুমুখীকরণের পাশাপাশি সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নেয়ার প্রবণতাও কমাতে হবে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নে বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে দেশীয় সম্পদ সংগ্রহ করতে না পারলে বিশেষ করে রাজস্ব আহরণে পিছিয়ে পড়লে ও কর-জিডিপি অনুপাত কম থাকলে বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা আরো বাড়বে।
দেশে এখন কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের কাছাকাছি। আবার দেশে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় কম হলে বৈদেশিক ঋণনির্ভরতাও দ্রুত হারে বাড়বে। বাংলাদেশে এখন সেটিই হচ্ছে। বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা বাড়ছে। সঠিকভাবে এটির ব্যবহার করতে না পারলে তা দেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে।
তিনি আরো বলেন, বৈদেশিক ঋণ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রাধিকার খাত ঠিক করতে না পারলে বা প্রকল্পের ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে না পারলে এসব অবকাঠামো থেকে ভবিষ্যতে আয় (আইআরআর) কমে যাবে।
আর্থিক ও অর্থনৈতিক আয় কম হলে সাধারণত সেবা প্রদানের চার্জ বেশি হারে ধার্য করা হয়। যেমন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, টোল হার বেশি নির্ধারণ করা। বাংলাদেশে ঋণের সঠিক ব্যবহার না হওয়ার কারণে এগুলো করতে হচ্ছে। ফলে বৈদেশিক ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে আরো কৌশলী হতে হবে।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বড় প্রকল্পের জন্য স্বল্প সুদে কঠিন শর্ত ছাড়াই বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন আছে। তবে সে ঋণের অর্থ অহেতুক ব্যয় না করে কিংবা অন্যান্য খাতকে সুবিধা না দিলে ঝুঁকি তৈরি করবে। ঋণ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে না পারলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে বাজেট বাস্তবায়ন, রিজার্ভ ও বিনিময় হারের ওপর চাপ বাড়াবে।
তাই ঋণ গ্রহণে এখনই সতর্ক অবস্থান নিতে হবে। স্বল্প সুদের কনসেশন ঋণ ছাড়া অন্য যেকোনো ধরনের ঋণ বিশেষ করে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট, শর্ট টার্ম ও হার্ড টার্ম ঋণ নেয়ার বিষয়টি যতটুকু সম্ভব পরিহার করতে হবে। আর বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণ গ্রহণের বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে। ফেরত দেয়ার সক্ষমতা বাড়াতে হলে অর্থ ব্যয়ে আরো বেশি স্বচ্ছতা ও কৃচ্ছতার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যথায় এ ঋণ দেশের জন্য বোঝা হয়ে যাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮১৬
আপনার মতামত জানানঃ