করোনার আতঙ্ক গ্রাস করেছে গোটা বিশ্বকে। তার উপরে ক্রমাগত বদলাচ্ছে আবহাওয়া। ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে সর্দি জ্বরের সমস্যা। এরই মধ্যে আরও এক অজানা জ্বর চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধুম জ্বর, গা-হাত পা ব্যথা, অথচ কোনও টেস্টেই ধরা পড়েনি কিছু। তীব্র জ্বর, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, পেটখারাপ, এমন নানাবিধ উপসর্গ নিয়ে শতাধিক শিশু পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
করোনার তৃতীয় ঢেউতে শিশুরা প্রভাবিত হবে বলে প্রথম থেকেই আশঙ্কা ছিল বিশেষজ্ঞদের। এই পরিস্থিতিতে এত সংখ্যক শিশু অজানা জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কারণ খুঁজছেন চিকিৎসকরা।
এ ঘটনায় বিবৃতি দিয়ে স্বাস্থ্য দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রাথমিকভাবে জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক বিভাগে গড়ে ভর্তি হচ্ছিল ৫০ থেকে ৬০ জন শিশু। তবে গত ৪ থেকে ৫ দিনে সংখ্যাটা একলাফে অনেকটা বেড়েছে। বর্তমানে শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছে ১২০-১৪০ রোগী। মূলত ১ থেকে ৪ বছর বয়সীরাই ভর্তি হয়েছে বলেও জানানো হয় বিবৃতিতে।
জানা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুদের মধ্যে থেকে মাত্র একজন করোনা আক্রান্ত। বাকি সবারই করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। আক্রান্ত শিশুকে রাখা হয়েছে আইসোলেশনে। অন্যদিকে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয়েছে শিশুদের।
এমন পরিস্থিতিতে রোগীর ভিড় সামলাতে হাসপাতালে বাড়ানো হয়েছে ৪৫টি শয্যা। এদিকে আক্রান্ত শিশুদের শরীরের তাপমাত্রা মাঝে মাঝে ১০৪-১০৫ ডিগ্রি উঠে যাচ্ছে। ওষুধ দুই ঘণ্টার বেশি কাজে দিচ্ছে না। জ্বরের সঙ্গে ছড়াচ্ছে পেটের অসুখ।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, জেলার ময়নাগুড়ি, জলপাইগুড়ি, ধুপগুড়ি সহ অন্যান্য ব্লকের পাশাপাশি কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ি ও মেখলিগঞ্জ থেকেও জ্বরে আক্রান্ত শিশুদের সেখানে পাঠানো হচ্ছে। ফলে হাসপাতালে শিশুদের ভিড় বাড়ছে। অনেক শিশুর জ্বর এতটাই বেশি যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে তারা। ওষুধ খাওয়ানোর কমপক্ষে দু-ঘন্টা পর জ্বর নামছে। আবার অনেকের জ্বরের সঙ্গে পেট খারাপ রয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে উপসর্গ করোনার মনে হলেও করোনা হয়নি বলেই জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার ডাঃ রাহুল ভৌমিক জানান, ‘ঋতু পরিবর্তনের ফলে ওই জ্বর হতে পারে। ঝুঁকি এড়াতে কোনও অভিভাবকই বাড়িতে না রেখে জ্বরে আক্রান্ত শিশুদের হাসপাতালে নিয়ে আসছেন। সকলেই যে সচেতন, এটা ভালো দিক’।
কনসাল্টিং ফিজিশিয়ান শিবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকাকে জানাচ্ছেন, দেশজুড়ে এই আতঙ্কের নাম স্ক্রাব টাইফাস। ‘স্ক্রাব টাইফাস’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ typhus থেকে যার অর্থ হল ধোঁয়াটে বা অস্পষ্ট। এঁটুলি পোকার মতো দেখতে ট্রম্বিকিউলিড মাইটস বা টিক-এর মতো পরজীবী পোকার কামড় থেকে এই রোগের জীবাণু মানবদেহে ছড়ায়। এই পোকাগুলির আকার ০.২ মিলিমিটার থেকে ০.৪ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়।
কোথায় থাকে এই পোকা?
সাধারণত গ্রাম বাংলার কৃষি জমিতে এই ধরনের পোকা দেখা যায়। যদিও শহুরে এলাকায় বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টে ছোট বুশ, ঝোপ-ঝাড়, গাছপালা কিংবা পোষ্যের গায়ে এই ধরনের পোকার দেখা হামেশাই মেলে।
প্রাথমিকভাবে এই পোকা কামড়ালে তেমন কিছু ব্যথা অনুভব হয় না। তবে পরে তা শরীরের ভিতরে গিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করে।
এই রোগের মূল লক্ষণগুলি কী কী?
সাধারণ জ্বরের মতোই এই রোগেও যে লক্ষণগুলি দেখা যায়, সেগুলি হল—
- সাংঘাতিক মাথা ব্যথা
- ধুম জ্বর
- গা-হাত-পায়ে ব্যথা
- সর্দি
- পিঠে ও বুকে র্যাশ (যা ক্রমশই ছড়াবে)
- লো ব্লাড প্রেশার
এগুলি ছাড়াও হার্টের সমস্যা, কিডনির সমস্যা, এমনকী পেটের সমস্যাও দেখা যায়।
কীভাবে এই রোগ ধরা হয়?
উপরের লক্ষণগুলি থাকলেই চিকিৎসকেরা বেশ কিছু পরীক্ষা করাতে দেন। যদিও সমস্ত ক্ষেত্রেই পরীক্ষার ফলে সেভাবে কিছু ধরা পড়ে না। চিকিৎসক শিবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এই সমস্ত ক্ষেত্রে রোগীকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করাটা খুব জরুরি। বেশ কিছু ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে পোকা কামড়ানোর দাগ পাওয়া যায়। এগুলিকে বলে এসকার। যা দেখেই সাধারণত রোগীদের শণাক্ত করা হয়ে থাকে।
এই রোগের চিকিৎসার উপায় কী কী?
চিকিৎসক শিবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, অ্যান্টিবায়োটিক ডক্সিসাইক্লিইন এই রোগের একমাত্র ওষুধ। ইতিমধ্যেই কোভিডের চিকিৎসায় এই ওষুধটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৮
আপনার মতামত জানানঃ