চলমান করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। একইসঙ্গে আগের দিনের তুলনায় কমেছে নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও। এর কারণ কি গোটা পৃথিবী জুড়ে টিকা নেয়া মানুষের সংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধি? করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সম্পূর্ণ ডোজ টিকা নিয়েছেন এমন ব্যক্তিরা কোভিডে আক্রান্ত হলেও মৃত্যুর আশঙ্কা কমে যায় প্রায় ১১ গুণ। এমনকি তাদের হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনাও কমে যায় ১০ গুণ।
গতকাল শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত রিপোর্টে এই তথ্য উঠে এসেছে বলে শনিবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি।
বার্তাসংস্থাটি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) সম্প্রতি তিনটি নতুন গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে। সেসব গবেষণাতেই উঠে এসেছে কোভিড টিকার কার্যকারিতা সংক্রান্ত এই তথ্য।
সিডিসি’র গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারতে প্রথম শনাক্ত করোনাভাইরাসের অতিসংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অন্য টিকার তুলনায় মডার্নার টিকা বেশি কার্যকর।
এ নিয়ে শুক্রবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সিডিসি’র ডিরেক্টর রচেল ওয়ালনস্কি বলেছেন, ‘একের পর এক গবেষণায় আমরা এটাই দেখেছি যে, করোনা প্রতিরোধে টিকা কাজ করছে।’
সিডিসি’র এই গবেষণা ও ফলাফল এমন এক সময়ে সামনে এলো যখন সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে করোনার এই উল্লম্ফন মোকাবিলায় বৃহস্পতিবার একটি নতুন ছয় দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর মধ্যে ব্যাপকভাবে টিকাদানের নির্দেশও রয়েছে।
নতুন এই নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সকারের ২৫ লাখ কর্মচারী, বেশিরভাগ হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের কর্মী এবং কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীর সংখ্যা ১০০ জনের বেশি হলে তাদের সবাইকে টিকা নিতে হবে।
কিছু কিছু সংস্থা ইতোমধ্যে কর্মীদের টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে অন্যথায় চাকরিচ্যুত করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। গত বৃহস্পতিবার বাইডেন বলেন, ‘আপনি যদি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চান অথবা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে চান, তাহলে টিকা নিন।’
সিডিসি’র প্রকাশিত গবেষণাপত্রের প্রথম কাজ হয়েছিল গত ৪ এপ্রিল থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত। এই সময়কালে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সে ভাবে প্রকট আকার ধারণ করেনি। এই সময়ের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে ২০ জুন থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত করা পর্যবেক্ষণকে। এই সময়কালে ডেল্টা সংক্রমণ শুরু হয়েছিল।
এই দুই ভিন্ন সময়ের পর্যবেক্ষণে টিকার কার্যকারিতা লক্ষ্য করেছেন মার্কিন গবেষকরা। এছাড়া টিকা নেওয়া ব্যক্তির জটিল সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা, টিকা না নেওয়া ব্যক্তির তুলনায় কতটা কম- সে সবই উঠে এসেছে এই গবেষণায়।
যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত তিনটি টিকা নেওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা কতটা কম সেটিও জানিয়েছে সিডিসি। তারা জানিয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ঠেকাতে মডার্নার টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর, ফাইজার ৮০ শতাংশ এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা ৬০ শতাংশ কার্যকর।
এএফপি জানিয়েছে, করোনা মোকাবিলায় বুস্টার ডোজের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বর্তমানে কাজ করছে সিডিসি ও ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)। বুস্টার ডোজ দেওয়ার বিষয়ে বাইডেন প্রশাসন অনুমোদন দিলে চলতি মাসের শেষের দিকে বয়স্ক মার্কিন নাগরিকরা প্রথমে সেটি নেওয়া শুরু করবেন।
এদিকে পাঁচ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের জন্য করোনা টিকার অনুমোদন দিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আগামী অক্টোবর মাসের শেষ নাগাদ অল্পবয়সী এই শিশুদের জন্য ফাইজারের টিকাকে অনুমোদন দেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
মার্কিন সংস্থা ফাইজার ও জার্মানির বায়োএনটেকের যৌথ উদ্যোগে তৈরি এই কোভিড-১৯ টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যাপ্ত তথ্য চলতি সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে হাতে পাওয়া যাবে। এরপরই পাঁচ থেকে ১১ বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে জরুরি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেতে এফডিএ-তে আবেদন করা যাবে।
জরুরি ব্যবহারের জন্য আবেদন লাভের পর শিশুদের শরীরে টিকার নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা খতিয়ে দেখা শেষ হলে তিন সপ্তাহের মধ্যে এফডিএ সিদ্ধান্ত জানাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, তিন সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ লক্ষাধিক শিশু করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। তাদের বয়স ১১ বছরের মধ্যে এবং এখনও করোনার টিকা দেওয়া হয়নি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে এখনো ১২ বছরের নিচে কোনো শিশুকে টিকা দেওয়া হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সংক্রণের ঊর্ধ্বগতিতে তৃতীয় ঢেউ আসার ইঙ্গিত স্পষ্ট। বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের তুলনায় তৃতীয় ঢেউয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিশুরা। বিশেষজ্ঞদের সেই পূর্বাভাসও বোধহয় মিলে যাচ্ছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন প্রায় ৯ হাজার মানুষ। একই সময়ে নতুন করে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫ লাখ ৯০ হাজার।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। দৈনিক মৃত্যুতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া। এতে বিশ্বব্যাপী করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২২ কোটি ৪৬ লাখের ঘর। অন্যদিকে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪৬ লাখ ২৯ হাজার।
আজ শনিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, মৃত্যু ও সুস্থতার হিসাব রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারস থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮ হাজার ৯৬৮ জন। অর্থাৎ আগের দিনের তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে প্রায় সাড়ে তিনশো।
একই সময়ের মধ্যে ভাইরাসটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ লাখ ৯০ হাজার ১৮১ জন। অর্থাৎ আগের দিনের তুলনায় নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কমেছে ৮ হাজারের বেশি। এতে মহামারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত ভাইরাসে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ কোটি ৪৬ লাখ ৮ হাজার ৬৪১ জনে।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ১১৪ জন এবং মারা গেছেন ১ হাজার ৭৩৩ জন। করোনাভাইরাসে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এই দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৪ কোটি ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ৬৮২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৯৮৯ জন মারা গেছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ