বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাংলাদেশে একটি পরিচিত কথা৷ বলা হয়ে থাকে, এই সংস্কৃতির কারণেই এখানে অপরাধীরা বেপরোয়া৷ তারা আইনকে গুরুত্ব দেয় না, অপরাধ করতে ভয় পায় না৷ তারা মনে করে অপরাধ করে পার পাওয়া যায়৷ তবে অপরাধীরা নির্ভয়ে থাকলেও স্বস্থি নেই সাধারণ মানুষের। বিরোধী দলের নেতা-কর্মী, ভিন্নমতাবলম্বী ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের উদ্দেশ্যে গুমের মাধ্যমে একধরনের ভয়ের যে সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছে, তা নিরাপত্তা বাহিনীর হাত ধরেই। অবাধ বিচারহীনতার সংস্কৃতি গুমকে উৎসাহিত করছে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতেই ‘গুম’ আতঙ্কে রয়েছেন মানুষ।
বাংলাদেশে গুম পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনের এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেছেন। মানবাধিকার রক্ষায় কংগ্রেসের ভেতরে ও বাইরে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এই কমিশন।
ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস সদস্য জেমস পি ম্যাকগভার্ন ও রিপাবলিকান পার্টির কংগ্রেস সদস্য ক্রিস্টোফার স্মিথের উদ্যোগে গতকাল মঙ্গলবার এই ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভা হয়। তাদের দুজনই কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনের কো-চেয়ারের দায়িত্বে আছেন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত ১৪ বছরে দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়াসহ নানানভাবে গুম হয়েছেন ছয় শতাধিক ব্যক্তি। যাদের অধিকাংশ সরকারের সমালোচনাকারী অথবা রাজনৈতিক নেতাকর্মী। এর মধ্যে ৭৮ জনের লাশ পাওয়া গেছে। প্রায় দেড় শ ব্যক্তির খোঁজ মিলেছে, যার মধ্যে অনেককে পাওয়া গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার দেখানোর পর। তবে বাকিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা আর জানা যায়নি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০০৭ থেকে ২০২০ (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত ৬১৪ জন গুমের শিকার হয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা অভিযোগ তুলেছেন। এদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন ফেরত এসেছে। অন্যদের বিষয়ে সুর্নিদিষ্ট তথ্য গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়নি।
এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, সাংবাদিক বা মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, বিশেষ বাহিনী-র্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেওয়া হচ্ছে। প্রায়ই সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে। পরিচিত কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া খুব কম ক্ষেত্রেই আলোচনা বা আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং উদ্ধারের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুম হওয়ার কিছুদিন পর হঠাৎ করেই তাদের কোনও মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় বা ক্রসফায়ারে তাদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। যারা ফিরে আসতে পেরেছেন তাদের ক্ষেত্রেও কী ঘটেছে তা জানা যায় না।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে বলেছে যে, বাংলাদেশে গুমের শিকার ৮৬ জন ব্যক্তি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ১১৫ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এদের মধ্যে গুমের শিকার হওয়া ভুক্তভোগী, তাদের পরিবারের সদস্য এবং গুমের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা ছিলেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দাবি করেছে যে প্রতিবেদনটি তৈরি করার সময় তারা দেখেছে যে, সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে এবং তাদের মত দাবিয়ে রাখতে গুম এবং গুমের হুমকিকে ব্যবহার করেছে।
বাংলাদেশের সরকার অবশ্য গুমের ঘটনায় কোন কর্তৃপক্ষ অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে।
গতকাল ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় বক্তারা বাংলাদেশে গুম বন্ধে জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকার ওপর জোর দেন। বিশেষ করে গুমের ঘটনাগুলোর র্যাবের নাম আসায় বাহিনীর জ্যেষ্ঠ সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও আলোচনায় উঠে আসে।
এই আলোচনার আগের দিন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলাম সভার আয়োজক মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য জেমস পি ম্যাকগভার্ন ও ক্রিস্টোফার স্মিথকে চিঠি লেখেন। সেখানে তিনি গুমের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। রাষ্ট্রদূত লেখেন, নিখোঁজের সব ঘটনাকে গুম হিসেবে বর্ণনা করার মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি ও অর্জনকে ক্ষুণ্ন করাটা উদ্বেগের। কারণ ‘ঘটনার শিকারে’ পরিণত হওয়া লোকজনের ফিরে আসার মাধ্যমে প্রমাণিত ‘তথাকথিত গুমের’ অভিযোগ মিথ্যা। কিছু দুষ্কৃতকারী র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম ভাঙিয়ে অপহরণে যুক্ত আছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেশাগত দক্ষতা আর বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের অপরাধমূলক তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে গুমের একটি মামলারও বিচার হয়নি কেন, তা একটি বড় প্রশ্ন। তার চেয়ে বিস্ময়ের ঘটনা হচ্ছে, যাদের নিরাপত্তা বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে যায়, বের হয়ে আসার পর তারা নিশ্চুপ হয়ে যান। ফলে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। কথা বলতে হলে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়। এ রকম এক নিপীড়নকারী সরকারের শাসনে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছেন।
মার্কিন কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনের ভার্চ্যুয়াল সভায় বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিদের বক্তব্য শোনেন কংগ্রেস সদস্যরা। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, গুম নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানটা কী, তা এই আলোচনা শুরুর আগে রাষ্ট্রদূতের চিঠি থেকে স্পষ্ট। অনেকের আশঙ্কা, সরকারের এ নিয়ে জবাবদিহির কোনো ইচ্ছাই নেই। এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে যে ৮৬ জনের কথা বলা হয়েছে, তারা আইনের আওতায় আসেননি।
এইচআরডব্লিউর এই কর্মকর্তা বলেন, র্যাবের বিরুদ্ধে যখন এত অভিযোগ, তখন তাদের বিচারহীনতায় রাখার মধ্য দিয়ে গুমকে উৎসাহিত করা হয়। এতে র্যাব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় কি না, সেটাই এক প্রশ্ন।
মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘কোভিড-১৯ মোকাবিলা নিয়ে সারা বিশ্বে তুমুল সমালোচনা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে এ নিয়ে নিজেদের মত প্রকাশ করতে গিয়ে লেখক মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কিশোরের যে পরিণতি হয়েছে, সেটি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে।’
আলোচনায় ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে গুমের একটি মামলারও বিচার হয়নি কেন, তা একটি বড় প্রশ্ন। তার চেয়ে বিস্ময়ের ঘটনা হচ্ছে, যাদের নিরাপত্তা বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে যায়, বের হয়ে আসার পর তারা নিশ্চুপ হয়ে যান। ফলে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। কথা বলতে হলে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়। এ রকম এক নিপীড়নকারী সরকারের শাসনে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যখন থাকে না, সংসদে যখন কোনো জবাবদিহির সুযোগ নেই, তখন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ দুরূহ। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিস্থিতি উত্তরণের একমাত্র পথ।’
এশিয়ান মানবাধিকার কমিশনের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, র্যাবকে বিচারহীনতার আওতায় রেখে কর্মকাণ্ড চালাতে দিয়ে ভিন্নমতের কণ্ঠ রোধ করা হচ্ছে। কারণ, গ্রেপ্তার এবং গুমের জন্য যখন কাউকে বীর হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়, তখন পরিস্থিতি বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
বিএনপির নেতা সাজুদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তার ভাইসহ গুমের শিকার সবার খোঁজ জানতে চান। গুমের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনাটা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
টেক্সাস থেকে ১১ বার নির্বাচিত ডেমোক্রেট কংগ্রেস সদস্য শীলা জেকসন লি প্রশ্ন করেন, এই পরিস্থিতির উত্তরণে নাগরিক সমাজকে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করতে পারে? শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগের বিষয়ে কী করা যেতে পারে?
জবাবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন রবার্ট এস কেনেডি হিউম্যান রাইটসের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যাঞ্জেলিটা বায়েনেস বলেন, এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অভিযুক্তদের নিয়োগের (শান্তিরক্ষা) সময় তার ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। এমনকি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩২
আপনার মতামত জানানঃ