মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশ সরকারের ছয়জন শীর্ষস্থানীয় সদস্য ও র্যাবের নয়জন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা ‘গ্যারনিকা ৩৭’৷
গত ২৪ আগস্ট এই চিঠি দেয়া হয় বলে জানিয়েছে গ্যারনিকা ৩৭৷ তবে সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত বিবৃতিতে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি৷
গ্যারনিকা ৩৭ অভিযোগ করে জানিয়েছে, র্যাবের কর্মকর্তারা শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত। ২০১৫ সাল থেকে ৪৪০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে র্যাব কর্মকর্তারা জড়িত বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে তারা৷ ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ অভিযান চলার সময় এমন হত্যাকাণ্ডের সংখ্যার নাটকীয় বৃদ্ধি ঘটে বলে জানিয়েছে গ্যারনিকা৷
এর পাশাপাশি তিনটি মানবাধিকার সংস্থা; হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস ও এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে বলেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বিদেশি সরকারগুলোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত৷
এই তিন সংস্থা অভিযোগ করে জানিয়েছে, অ্যাক্টিভিস্ট, সমালোচক ও বিরোধী দলের সদস্যদের গুমের বিষয়গুলো তদন্তে বাংলাদেশ সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণ, বিদেশে থাকা তাদের সম্পদ ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সেবা গ্রহণে তাদের উপর যেন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় সেটা সরকারগুলোর (বিদেশি) নিশ্চিত করা উচিত৷’’
এর আগে ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত গুমের ঘটনা নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১৬ আগস্ট একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন এসব অভিযোগ ‘মিথ্যা’ বলে মন্তব্য করেছেন৷
এদিকে সূত্র মতে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মার্কিন কংগ্রেসের ‘টম ল্যান্টোস হিউম্যান রাইটস কমিশন’কে বাংলাদেশের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজ বন্ধ করা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের কীভাবে বাংলাদেশকে চাপ দেয়া উচিত সে ব্যাপারে অবহিত করবে বলে জানা গেছে।
A new report by @hrw documents widespread enforced disappearances by Bangladesh security forces under Prime Minister Sheikh Hasina’s Awami League-led government from 2009 to 2020. https://t.co/LFY9PXVs3T
— Tom Lantos Human Rights Commission (@TLHumanRights) August 30, 2021
জানা যায়, এই সময় বাংলাদেশের অ্যাক্টিভিস্ট শহিদুল আলম, গুম হওয়া বিরোধী কর্মী সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম এবং রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস ও এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন৷
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ শুরুর দিকের র্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
তবে জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে র্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ র্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিস্টেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে র্যাব জড়িত ছিল৷
২০১৪ সালের মে মাসে র্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন র্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর র্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়।
তবে বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে র্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সে ধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু র্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’ মূলত এই বলেই দায় এড়াতে চেয়েছে সরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২২৫৩
আপনার মতামত জানানঃ