জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার অংশ বাদ দেয়ার ঘটনায় সরকার কিংবা সরকারি দল আওয়ামী লীগের কোনো মহলের ইচ্ছাকৃতভাবেই রদবদল ঘটিয়ে রেখেছিল বলে দাবি করেছেন প্রবীণ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তিনি বলেন, জাতির পিতার ভাষণে (নভেম্বর, ১৯৭২) ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে যে নীতিনির্ধারক কথা রয়েছে, সরকার কিংবা সরকারি দলের কোনো মহল ইচ্ছাকৃতভাবেই তাতে বেশ আগেই রদবদল ঘটিয়ে রেখেছিলেন। তাদের ইচ্ছা হয়তো, জাতির পিতা যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের একটি মূল আদর্শ হিসেবে তার সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন, তা যেন বর্তমানের প্রজন্মের কেউ জানতে না পারে।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেন, ‘শাক দিয়ে কি মাছ ঢাকা যাবে? সরকার ও সরকারি দল যদি এমন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুটি নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কর্তন করার দুঃসাহস যারা দেখিয়েছে, তাদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে; তাহলে জনমনে স্বস্তি ফিরে আসবে। আর তা যদি তারা না করে, তাহলে তার রাজনৈতিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে দেখা না দিলেও সময়মতো দেখা দেবে এবং সরকারকে সেজন্য খেসারত দিতে হবে।
প্রসঙ্গত, জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে গত ১৫ নভেম্বর ২০২০, রবিবার জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাধারণ প্রস্তাব গ্রহণের আগে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংসদে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অডিও শোনানো হয়। ৪৬ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের প্রণীত সংবিধান সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেন। স্বভাবতই ভাষণটিতে থাকার কথা রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা। কিন্তু সংসদে প্রচারিত অডিওতে মূলনীতির প্রথম তিনটি বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কথাবার্তা থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে তাঁর বক্তব্যের অংশটি ছিল না।
রাজনীতিতে ভাষণ কর্তনের কালচার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জাতির শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিদের, এমন কী জাতির পিতার ভাষণও নিজেদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে গোপনে কেটে ফেলার যে কালচার দেশের রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে, আধুনিককালে তার প্রচলন পাকিস্তানে মুসলিম লীগ শাসনামলে। স্বাধীন বাংলাদেশে এ কালচারটি অনুসরণ করে বিএনপি সরকার। দুঃখের বিষয়, এ কালচারটি এখন আওয়ামী লীগ
সরকারের আমলেও অনুসৃত হতে দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ আমলে সেই একই ঘৃণ্য কালচার প্রশ্রয় পাবে, তা ভাবতে পারিনি। জাতির পিতার বক্তৃতা প্রচারে যেখানে বাধার সৃষ্টি করা হয়, সেখানে সাধারণ মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশে অহরহ বাধার সৃষ্টি হবে; তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে!’
তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘এটা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বছর। মুজিব বর্ষ। এবং তার ভাষণটিও প্রচারিত হচ্ছিল জাতির সার্বভৌমত্বের প্রতীক জাতীয় সংসদে। এত বড় দল। এত বড় সরকার। তাদের মধ্যে কি একজন মানুষও ছিলেন না, যিনি বা যারা ভাষণটি সম্প্রচার হওয়ার আগে একবার পরীক্ষা করে দেখতে পারতেন? একটি নব্যস্বাধীন জাতির স্বাধীনতা লাভের ঊষালগ্নে জাতির ভাগ্য নির্ধারক বাণী এবং তা দিয়েছেন জাতির পিতা, সেটা প্রচারের আগে পরীক্ষা করে দেখার কথা একবারও কি কারও মনে জাগেনি?’
তিনি আরো বলেন, ‘জাতির পিতার বাণী, তার আদর্শ ও নীতিনির্ধারক ঘোষণা সম্পর্কে জাতি আজ ৪৮ বছর পর আওয়ামী লীগের কাছে একটি সিদ্ধান্ত চায়। এ সিদ্ধান্তটি আওয়ামী লীগ জাতিকে জানাবে কি?’ সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর এমন অভিযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে এখনো কেউ মুখ খোলেননি। তিনি আওয়ামী রাজনীতির পক্ষের একজন চিন্তক। তার এ সমালোচনা গ্রহণ করে সরকার দলের মধ্যেকার মৌলবাদী অংশকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেবে, এমন দাবি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুরাগীদের।
মিই/আরা/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ