পড়ালেখার খরচ কম ও বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার সুযোগ থাকায় উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে পছন্দের দেশ জার্মানি। তবে সেই জার্মানিতেই এবার শত শত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে৷ করোনার কারণে ভিসা প্রক্রিয়াকরণে দীর্ঘসূত্রতায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মূলত প্রতিবছর উচ্চতর শিক্ষার জন্য জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায় অসংখ্য শিক্ষার্থীরা।
কিন্তু এবার অনেকেরই শিক্ষাজীবন হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত৷ কারণ ইতিমধ্যে করোনার বিধিনিষেধ কাটিয়ে উঠেছে জার্মানি। আর জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও শীতকালীন সেমিস্টারের ক্লাস অনলাইনের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে ক্যাম্পাসে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ জার্মানিতে শিক্ষার্থীদের ভিসার উপর নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও, শুধুমাত্র দূতাবাসে লোকবলের অভাবকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে ভিসা প্রক্রিয়াকরণে অস্বাভাবিক দেরী করা হচ্ছে। সরকারও এক্ষেত্রে উদাসীন; যোগাযোগ আলোচনার বাইরে কোনো পদক্ষেপই চোখে পড়ছে না সংশ্লিষ্টদের।
এ পরিস্থিতিতে কয়েক মাস আগে আবেদন করেও বাংলাদেশে জার্মান দূতাবাসে ভিসার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা৷ এদিকে, শীতকালীন সেমিস্টার শুরুর কেবল এক মাস বাকি৷ সূত্র মতে, প্রায় সকলেই এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণের অর্থ ব্যাংকের ব্লকড অ্যাকাউন্টে জমা করে দিয়েছেন৷
অনেকের আশঙ্কা, সময়মতো ভিসা না পেলে তাদের সেমিস্টার ড্রপ করতে হতে পারে৷ এ নিয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা জার্মান দূতাবাসের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করলে দূতাবাস জানিয়েছে, করোনার কারণে বাংলাদেশে দীর্ঘসময় একাধিকবার লকডাউন চলতে থাকায় কর্মীসংখ্যা কমিয়ে আনতে হয়েছে৷ অন্যদিকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ভিসা কার্যক্রম চালাতে গিয়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দৈনিক ভিসার আবেদন গ্রহণের সংখ্যাও কমিয়ে আনতে হয়েছে৷
সদ্য সাবেক হওয়া বাংলাদেশে জার্মান রাষ্ট্রদূত পেটার ফারেনহোলৎসও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের এমন দুর্দশার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে জুন মাসে একটি টুইট করেন৷ দ্রুতই কর্মীসংখ্যা বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের ভিসা জটিলতাকে গুরুত্ব দিয়ে নিরসনের কথাও বলেছিলেন তিনি৷ কিন্তু ওই কথআ অব্দিই; দুই মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সে সংকটের সমাধান হয়নি৷
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি ইউনিভার্সিটি অফ ব্রেমেন এর ডিজিটাল মিডিয়া এন্ড সোসাইটি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র মোঃ নাজিম উদ্দীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও এ ব্যাপারে কথা বলেছেন৷ তবে সেখানে কথা বলেও কার্যকর কোন সমাধান পাননি।
তিনি গনমাধ্যমকে জানান, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে জার্মান দূতাবাস এবং বার্লিনে বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে৷ তবে একই সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংকটের তড়িৎ সমাধান নাও হতে পারে, এমন আশঙ্কার কথাও তুলে ধরা হয়েছে৷
চৈতী জান্নাত নামে এক শিক্ষার্থী জানান, জার্মান দূতাবাসে এক বছর আগে তিনি ভিসার জন্য আবেদন করেছেন৷ কিন্তু এখনও কোনো উত্তর পাননি৷ অক্টোবরের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত থেকে ক্লাসে শুরু করতে না পারলে হয়তো তাকে ভর্তি বাতিল করতে হতে পারে৷
ফ্রেডরিশ আলেক্সান্ডার ইউনিভার্সিটির ছাত্র মোস্তফা কামালকে ভিসার জন্য নয় মাস অপেক্ষা করতে বলা হলেও এক বছরেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি দূতাবাসের পক্ষ থেকে৷ বাংলাদেশে থেকে অনলাইনে দুই সেমিস্টারের পড়াশোনা শেষ করলেও পরবর্তী সেমিস্টার তাকেও বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত থেকেই করতে হবে৷
সাজ্জাদ হোসেন কেম্পটেন অ্যাপ্লাইড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির অ্যাডমিশন লেটার পেলেও তাকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে৷ অন্যথায় তার আবেদন বাতিল হতে পারে৷ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থী শাহরিয়া ফরিদ এশাও একই ধরনের আশঙ্কার কথা তুলে ধরেছেন৷
তিনি জানিয়েছেন, তার বিশ্ববিদ্যালয় অক্টোবর থেকে ক্লাসে বাধ্যতামূলক উপস্থিতির নির্দেশ দিয়েছে৷ কিন্তু গত বছর নভেম্বরে ভিসার আবেদন করেও তিনি এখনও কোনো সাড়া পাননি৷
অনেক জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কোনো বিষয়ে কেবল শীত বা গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টারেই ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়৷ এক্ষেত্রে অনেকে সেমিস্টার ড্রপ দিলে শিক্ষাজীবন থেকে এক বছর হারিয়ে ফেলার শঙ্কাও করছেন৷
এ বিষয়ে জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘‘কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ২০২০ সালের শুরু থেকে জার্মানিতে প্রবেশের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে কেবল এসব বিধিনিষেধের বাইরে থাকা ব্যক্তিদেরই ভিসা দেয়া হচ্ছে৷ এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ভিসা ক্যাটাগরি যেমন পারিবারিক পুনর্মিলন, পড়াশোনা এবং কিছু দক্ষ কর্মীদের ভিসাও রয়েছে৷”
তবে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ভিসা জটিলতার বিষয়টি সম্পর্কে জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবগত আছে। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ‘‘জার্মানি আসতে চাওয়া শিক্ষার্থীদের কঠিন পরিস্থিতির বিষয়টি আমরা অবগত রয়েছি৷ তবে দূতাবাস কর্মী এবং শিক্ষার্থী, উভয়ের সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশসহ আমাদের সব দূতাবাস কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা হাতে নিয়েছে (যেমন শিফটে কাজ করা, আবেদনের জায়গা ও অপেক্ষার জায়গায় ন্যূনতম দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি)৷”
“এর ফলে আবেদনকারী ভিসার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের আওতায় না পড়লেও, পুরো আবেদন প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব পড়েছে এবং ভিসার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার অপেক্ষা দীর্ঘ হচ্ছে৷ আমরা এখন ভিসা প্রক্রিয়াকরণ দ্রুত করার জন্য কী কী ব্যবস্থা নেয়া যায়, তা মূল্যায়ন করে দেখছি৷”
তবে এই দ্রুত করার প্রক্রিয়া কবে থেকে শুরু হবে, বা ভিসা না পেলে শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুরোধ করা হবে কিনা, সে ব্যাপারে কিছু জানায়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ ভিসা প্রক্রিয়াকরণে ধীরগতির মধ্যেও কিছু সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সম্প্রতি জার্মানিতে আসতে পেরেছেন৷ তবে বাকিদের অক্টোবরে শীতকালীন সেমিস্টারে ক্যাম্পাসে উপস্থিত থেকে ক্লাস শুরুর কী হবে, সে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে৷
প্রসঙ্গত, মহামারির শুরুতে জার্মানিতে প্রায় চার লাখ বিদেশি ছাত্র পড়াশোনা করতো। এর মধ্যে বাংলাদেশি ছিল ৩ হাজার ২২০ জন। জার্মান সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছরই দেশটিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। উল্লেখ্য, বিশ্বের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ১৩ শতাংশই জার্মানিতে পড়াশোনা করছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা মূলত সাহায্য পাচ্ছে না কোনও পক্ষেরেই। সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা ছাড়া সরকার থেকেও কেউ তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। পুরো করোনাকালেই গোটা দেশের শিক্ষার্থীরা যেন সরকারের যাবতীয় মনোযোগের বাইরে আছে। দেশের প্রায় ধসে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থার কারণে ভুগছে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী। এবার সংশ্লিষ্টদের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব আর উদাসীনতায় শুধুমাত্র ভিসার জন্যই অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে শত শত শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬৩৮
আপনার মতামত জানানঃ