সম্প্রতিই টাকা খোয়া যাওয়ার অভিযোগ ওঠে লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয় থেকে। কিন্তু টাকা খোয়া যাওয়ার এই অভিযোগ তোলা খোদ রামগতির পিআইও রিয়াদ হোসেনকে বদলি করেছে প্রশাসন। জেলা প্রশাসক (ডিসি) আনোয়ার হোছাইন আকন্দ মঙ্গলবার তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। একই সাথে তিনি জানান, নতুন পিআইও যোগদান না করা পর্যন্ত অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবেন সদর উপজেলার পিআইও মোশারফ হোসেন।
জানা যায়নি বদলির কারণ
রামগতি উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের প্রশাসন-১ অধিশাখার উপসচিব হাবিব উল্ল্যাহ বাহারের স্বাক্ষর করা চিঠিতে পিআইও রিয়াদের বদলির নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি তাকে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলায় যোগ দিতে বলা হয়েছে।
কার্যালয়ে ওই টাকার উৎস খুঁজতে তদন্ত কমিটি করেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ। পরবর্তী সময়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) শতরূপা তালুকদারের তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে পিআইও রিয়াদকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বদলি প্রসঙ্গে ডিসি আনোয়ার জানান, তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই বদলি করা হয়েছে পিআইওকে। তবে তদন্তে কী পাওয়া গেছে তা জানাননি তিনি। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি তদন্ত কর্মকর্তা শতরূপা তালুকদারও।
পিআইও রিয়াদকে ঘিরে সন্দেহ
রিয়াদ হোসেন রামগতি উপজেলার পিআইও থাকা অবস্থায় কমলনগর উপজেলার পিআইও হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছিলেন। কমলনগরে থাকার সময় গত ২৮ জুন রাতে কার্যালয় থেকে টাকা চুরির অভিযোগে চার কর্মচারীকে থানায় নিয়ে যান তিনি।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাতে তাদের ছেড়ে দেয়া হলেও পরদিন সকালে আবারও চারজনকে থানায় ডাকা হয়। তবে কত টাকা খোয়া গেছে নিশ্চিতভাবে বলতে পারেননি পিআইওসহ কেউই।
কমলনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোসলেহ উদ্দিন সে সময় বলেছিলেন, রিয়াদ তার অফিস সহকারী আবদুল বাকেরসহ চারজনকে নিয়ে রাতে থানায় হাজির হন। তিনি অভিযোগ করেন, কার্যালয়ে তার কক্ষের আলমারি থেকে কয়েক লাখ টাকা গায়েব হয়েছে। জানান, ওই চার কর্মচারী টাকা চুরি করেছেন।
ওসি মোসলেহ উদ্দিন বলেন, ‘রিয়াদ বলেছেন ঠিক কত টাকা ছিল সে হিসাব তার নেই। কখনও বলেন ৭ লাখ, কখনও ১০ লাখ টাকা। রিয়াদ ও চার কর্মচারীকে আলাদাভাবে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর কেউই পরিষ্কার কোনো তথ্য দেননি। কারও সঙ্গে কারও কথাও মেলেনি। এ কারণে চারজনকে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে মঙ্গলবার সকালে আবার তাদের থানায় আনা হয়েছে।’
ওসি জানান, টাকা চুরির অভিযোগ করলেও রিয়াদ হোসেন কোনো মামলা বা লিখিত অভিযোগ দেননি। এত নগদ টাকা কোথা থেকে এলো, জানতে চাইলে রিয়াদ দাবি করেন, এগুলো বিভিন্ন লাইসেন্স ও কালেকশনের টাকা। তবে সে বিষয়েও সুনির্দিষ্ট তথ্য তিনি দেননি।
এতে করে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। প্রকল্পের টাকা হলে তার পূর্ণ হিসাব থাকার কথা। কিন্তু কোনও হিসাবই বা সেই টাকার উৎস সম্পর্কে যথাযথ তথ্য দিতে পারছেন না এই কর্মকর্তা। অনেকেই অভিযোগ করছেন, প্রকল্পের যাবতীয় লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে হওয়ায় এই বিপুল পরিমাণ টাকা বৈধ হবার সম্ভাবনা নেই। এরই মধ্যে একের পর অভিযোগ উঠছে এই পিআইও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। যদিও পরবর্তীতে জানা যায়, এই অর্থের পরিমাণ ১৭ লাখ টাকা।
নাটক সাজিয়েছিলেন রিয়াদ
উপজেলা কার্যালয়ের কর্মীরা জানান, পিআইও’র কার্যালয়ে নগদ টাকা থাকার কথা নয়। তিনি ঠিকাদারদের চেকের মাধ্যমে টাকা দেবেন। টেন্ডারের পে-অর্ডারও চেকের মাধ্যমে হবে।
তাহলে তার কার্যালয়ে ১৭ লাখ টাকা কোথা থেকে আসলো? আর টাকাগুলো কিসের? যার জন্য এখনও তিনি পরিষ্কারভাবে কোনেও অভিযোগ করতে পারছেন না। উল্টো চার জন কর্মচারীকে থানায় নিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন কর্মীরা।
এদিকে, পিআইও কার্যালয়ের কর্মচারী ভুক্তভোগী বাকের আল মেহেদির স্ত্রী শারমিন আক্তার অভিযোগ করেছেন, পিআইও নিজেই তাদের বাসায় গিয়ে টাকা খোঁজার নামে তল্লাশি চালিয়েছেন। এ সময় প্রকল্প কর্মকর্তা বাসার আসবাবপত্র তছনছ ও ভাঙচুর করেছেন বলেও অভিযোগ এনেছেন শারমিন।
ঠিকাদারদের অভিযোগ
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সে সময় কয়েকজন ঠিকাদার জানান, টেন্ডারের পে-অর্ডার হয় চেকের মাধ্যমে। ঠিকাদারের সঙ্গে সব লেনদেন হয় চেকে। পিআইওর কাছে এসব নগদ টাকা বৈধ নয়।
এক ঠিকাদার অভিযোগ করেন, পিআইও রিয়াদ ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল বা বিলের চেকে সই করেন না। কয়েক মাস আগে কয়েকটি কাজের বিলের চেকে সই করার জন্য কয়েকজনের কাছ থেকে তিনি ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন।
তার মূল কর্মস্থল রামগতি উপজেলায়। এখন কমলনগরে অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন। দুই উপজেলার ঠিকাদার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তার কাছে জিম্মি।
ঠিকাদারদের একজন জানান, বিভিন্ন প্রকল্পের জুন ক্লোজিংয়ে প্রকল্প সভাপতি, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছেন পিআইও। এসব টাকা তার হয়ে কালেকশন করতেন তার অফিস সহকারী আবদুল বাকের। পরে বাকেরের সঙ্গে পিআইওর মনোমালিন্য হয়। এর জেরে টাকা উধাওয়ের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
উপজেলার কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান জানান, জুন ক্লোজিং উপলক্ষে পিআইও তাদের কাছ থেকে কমিশন নিয়েছেন। কমিশন দিতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে। ঘুষের ১৬ লাখ টাকা নিয়ে তিনি সংশ্লিষ্টদের বিল পাস করে দেওয়ার কথা। দুদকের মাধ্যমে সুষ্ঠু তদন্ত বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্যের সব তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে দাবি করেন তারা।
এ বিষয়ে কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘পিআইওর অফিসের আলমারি থেকে টাকা উধাওয়ের বিষয়টি শুনেছি। চারজনকে থানায় ডাকা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বিষয়টি কী, সেটা জানার চেষ্টা করছি। আসলে কিসের টাকা বা কত টাকা সেটাও জানি না।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬৪২
আপনার মতামত জানানঃ