সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশ যখন করোনা যুদ্ধ মোকাবিলায় ব্যস্ত সময় অতিক্রম করছে, তখন ডেঙ্গু জ্বরের উচ্চ প্রকোপ আমাদেরকে নতুন করে আতঙ্কগ্রস্ত করছে। করোনা ও ডেঙ্গু উভয়ের প্রাথমিক উপসর্গ জ্বর, যা সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে। একইসাথে শিশুদের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বর সংক্রমণের হারও বেশি থাকায় অভিভাবকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। করোনার পাশাপাশি শিশুদের ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বাড়ায় স্বাস্থ্য খাত নতুন করে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।
জানা যায়, আজ শুক্রবার রাজধানীর শিশু হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৭৬ শিশু। একে একদিনে সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী ভর্তি থাকার রেকর্ড বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এর আগে ২০১৯ সালে এক দিনে হাসপাতালটিতে সর্বোচ্চ ৬৯ জন রোগী ভর্তি ছিল। আজ সেই রেকর্ড ভেঙে গেল।
চলতি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে দেখা যায়। দ্বিতীয় সপ্তাহে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমতির দিকে ছিল। কিন্তু তৃতীয় সপ্তাহে এসে আবার ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল ও শ্যামলীর শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে ৭ হাজার ২৫১ জন। তাদের মধ্যে গতকাল ১ হাজার ২৩৮ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তাদের মধ্যে ১ হাজার ১৪৫ জনই ভর্তি ছিল রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। চলতি বছর ৩১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
এর আগে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ওই বছর সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখের বেশি মানুষ। সরকারি হিসাবে, ওই বছর ডেঙ্গুতে মারা যায় ১৭৯ জন। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ৩০০ জনের বেশি।
চিকিৎসকেরা বলছেন, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা এখন আগের চেয়ে বেড়েছে। তাই শিশুরা যাতে অক্রান্ত না হয়, সে জন্য প্রতিটি বাসায় অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে। ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ সম্পর্কে তারা বলছেন, জ্বর, মাথাব্যথা, চোখব্যথা, মাংস পেশিতে ব্যথা, শরীরে র্যাশ ওঠা, মুখ থেকে রক্তক্ষরণ, পেট ফুলে যাওয়া, শরীরে পানি আসা। এসব লক্ষণ নিয়ে শিশুরা হাসপাতালে আসছে।
তারা বলছেন, শিশুরা ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হলে খুব দ্রুতই পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। কেননা শিশুদের শারীরিক গঠন প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম। কিন্তু শিশুদের ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো একই রকম। এগুলো হচ্ছে, উচ্চমাত্রার জ্বর, মাথা-চোখ-মাংসপেশির ব্যথা, গিরায় গিরায় ব্যথা, রক্ত বমি হওয়া, শরীরে লাল লাল দাগ হওয়া, নাক-মাড়ি দিয়ে রক্ত ঝরা প্রভৃতি। এছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর জ্বর কমে যাওয়ার পরও রোগটি সংকটময় অবস্থায় চলে যেতে পারে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরের শুরু থেকেই শঙ্কা ছিল বাড়বে ডেঙ্গু। ঘটছেও তাই। বিশেষ করে হাসপাতালের বিছানায় শিশুরাই বেশি। তবু টনক নড়ছে কই? দুই সিটির অভিযানে প্রতিদিনই মিলছে এডিস মশার লার্ভার দেখা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু, করোনা ও ইনফ্লুয়েঞ্জা সবগুলো রোগের সাধারণ উপসর্গ হলো জ্বর। তাই শিশুদের জ্বর হলে সাধারণ ফ্লু মনে করে ঘরে বসে থাকা যাবে না। সাথে সাথেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। করোনা সংক্রমণ রোধে এখন সরকারকে প্রায়ই লকডাউন ঘোষণা করতে হচ্ছে। যদি চিকিৎসকের পরামর্শ পেতে দেরি হয়, তাহলে অপেক্ষা না করে দ্রুত করোনা পরীক্ষা, রক্তের সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) ও এসএসওয়ান এন্টিজেন্ট পরীক্ষা করানো উচিত। একই সাথে দ্রুত সময়ের মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু শনাক্তে প্রয়োজনীয় অন্যান্য পরীক্ষাগুলো করতে হবে।
তারা বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ মূলত রাজধানী ঢাকাতে বেশি এবং ডেঙ্গু জ্বরে যারা মৃত্যুবরণ করছে তাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেশি। তাই বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং শিশুদের সুরক্ষায় অভিভাবকদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, তা না হলে করোনা দুর্যোগের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সত্যিই কষ্টসাধ্য হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ