পাহাড়ি ঢল ও ভারতের গজলডোবার সব গেট খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে তিস্তা ব্যারেজে এখনো বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়ায় লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার ৫০টির অধিক চর ও পাঁচটি উপজেলার চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যারেজের সবকটি জলকপাট খুলে রেখেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে শুক্রবার সকাল ৬টায় বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার এবং সকাল ৯টার পর থেকে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ৯টার পর বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও মধ্যরাত থেকে কমতে থাকে পানির প্রবাহ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া বিভাগের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ভারতের সিকিমে বৃষ্টিপাত হওয়ায় তিস্তায় পানি বেড়েছে।
তৃতীয় দফায় পানি বাড়ায় তিস্তাপাড়ের বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। পানি বাড়ায় ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, নাউতারা, খালিশা চাপানি, ঝুনাগাছ চাপানি, খগাখড়িবাড়ি, গয়াবাড়ি এবং জলঢাকা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী, গোলমুন্ডা ও কৈমারী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ডালিয়া ডিভিশনের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সিকিমে বৃষ্টিপাত হওয়ায় তিস্তায় পানি বেড়েছে। ফলে তিস্তা নদীবেষ্টিত ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের মানুষ পড়েছে চরম বিপাকে। অনেকের বাড়ির চুলাসহ আশপাশ ডুবে গেছে। এতে রান্না করা বন্ধ হয়ে গেছে।
ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, ছাতুনামা, ভেন্ডাবাড়ি, কেল্লাবাড়ির চরের প্রায় ৬০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের বাড়িতে চুলা ডুবে যাওয়ায় তারা ঠিকমতো রান্না করতে পারছে না। এতে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করতে হচ্ছে তাদের।
খালিশা চাপানি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আতাউর রহমান সরকার বলেন, ‘বাইশপুকুর ও ছোটখাতা চরের ৩০০-এর বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের অনেকেই তিস্তা ব্যারেজের কলম্বিয়া বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদৌলা জানান, ভারতের সিকিমে বৃষ্টিপাতের কারণে উজানে তিস্তায় পানি বাড়ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যারেজের সবকটি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। তিস্তা এলাকা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়শ্রী রানী রায় বলেন, পানিবন্দি ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের মানুষের জন্য ছয় টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে এই চাল বিতরণ করা হবে। এ ছাড়া বিতরণ করা হবে শুকনা খাবার।
জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, তিস্তা এলাকা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা যেন সহায়তা পান সে জন্য জনপ্রতিনিধিদের সার্বক্ষণিক বিষয়টি দেখতে বলা হয়েছে।
তিস্তার ভাঙনে জমি-বাড়ি নদীগর্ভে
এদিকে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনার চরের ৪০ একর ফসলি জমি, ৫০টি ঘর-বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ইতোমধ্যে পশ্চিম বিনবিনার পাকার মাথা এলাকার কাঁচা রাস্তা ভেঙে গেছে। আর তিন ফুট রাস্তা ভাঙলেই নদী লোকালয়ে ঢুকে ফসলি জমি, ঘর-বাড়িতে হানা দেবে। এতে করে পুরো বিনাবিনার চর গ্রামের ফসলি জমি ও শত শত ঘরবাড়ি তিস্তা নদীতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনেক পরিবার ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পেতে তাদের বাড়ি-ঘর সরিয়ে নিয়েছে। এদিকে নদী ভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড তড়িঘড়ি করে জিও ব্যাগ ডাম্পিং শুরু করলেও তাতে কাজের কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য ভুট্টু মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, দফায় দফায় তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে নদী ভাঙন আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে প্রায় ২০ একর ফসলি জমি এবং অর্ধ শতাধিক বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বিষয়টি ইউপি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী তবিবুর রহমান জানান, বিনাবিনার চরের ভাঙনরোধে যা বরাদ্দ ছিল সেই অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তারপরেও ভাঙনরোধ করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে নতুন করে কোনও বরাদ্দ পাওয়া না গেলে শত শত বাড়ি-ঘর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
তিস্তা ব্যারেজের ৪৪ গেট খুলে পানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা
লালমনিরহাটের হাতিবান্ধায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প এলাকায় উজানের ঢলের পানিতে বিপৎসীমা অতিক্রম করে ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানিপ্রবাহ পরিমাপ করা হয়। ১২ ঘণ্টা পর শুক্রবার (২০ আগস্ট) সকাল ৯টায় ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিলো। এদিকে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ পাঠক নুরুল ইসলাম জানান, সকাল ১১টায় পানি বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভারতের গজল ডোবার সব গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় আমরাও সব গেট খুলে দিয়ে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছি।
জানতে চাইলে নুরুল ইসলাম বলেন, ভারতের পানিতেই বন্যা হয়েছে। এছাড়া যেভাবে ধূলিমিশ্রিত ঘোলা পানি আসছে, তাতে তিস্তার ভাটিতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাবে। যে কারণে অল্পপানিতে বিপৎসীমার উপর দিয়ে পানিপ্রবাহিত হয়ে বন্যা হচ্ছে। খনন কাজ পরিচালনা ছাড়া পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ভারতের পানিতেই বন্যা হয়েছে। এছাড়া যেভাবে ধূলিমিশ্রিত ঘোলা পানি আসছে, তাতে তিস্তার ভাটিতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাবে। যে কারণে অল্পপানিতে বিপৎসীমার উপর দিয়ে পানিপ্রবাহিত হয়ে বন্যা হচ্ছে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশী মিজানুর রহমান বলেন, তিস্তা নদীর ভারতীয় অংশের তীরবর্তী অববাহিকা অঞ্চলে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এতে প্রচুর ঘোলা পানি আসছে। এ কারণে তিস্তা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে চর সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া পানি দুই তীরে উপচে পড়ার কারণে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
বিপৎসীমার ওপরে তিস্তা-পদ্মা-যমুনার পানি
বৃষ্টিপাত বাড়ায় নদ-নদীর পানি হুহু করে বাড়ছে। কূল উপচে প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল। পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার আভাস রয়েছে।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রে জানিয়েছে, সুরমা ছাড়া দেশের সব নদ-নদীর পানি বাড়ছেই। তিস্তা, পদ্মা, যমুনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের চলমান বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বৃষ্টিপাত ও নদ-নদীর পরিস্থিতি সম্পর্কিত প্রতিবেদনে এ শঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, সুরমা ছাড়া দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানি আরো বৃদ্ধি পেতে পারে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তরাঞ্চলের তিস্তা অববাহিকাভুক্ত নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের মধ্যাঞ্চলের রাজবাড়ী ও ফরিদপুর জেলার নিম্নাঞ্চলগুলোর বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলেও প্রতিবদনে উল্লেখ করা হয়।
এতে আরও বলা হয়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর মথুরা ও আরিচা পয়েন্টের এবং পদ্মা নদীর সুরেশ্বর পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। তিনটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে জানিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা নদীর পানি রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপত্সীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে, গড়াই নদীর পানি কামারখালী পয়েন্টে বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ভারতের ওড়িশা ও কাছাকাছি এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি গুরুত্বহীন হয়ে মৌসুমি বায়ুর অক্ষের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি থেকে প্রবল অবস্থায় রয়েছে।
এদিকে ওড়িশা ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি গুরুত্বহীন হয়ে মৌসুমি বায়ুর অক্ষের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মৌসুমি বায়ুর অক্ষের বর্ধিতাংশ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত আছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি থেকে প্রবল অবস্থায় আছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৭
আপনার মতামত জানানঃ