ঢাকার বায়ু দূষণের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেছে যানবাহনের ধোঁয়া। এ কথা কয়েক বছর ধরেই বিশেষজ্ঞরা বলে আসছিলেন। সাম্প্রতিক এক গবেষণায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শহরগুলোতে চালানো এই গবেষণায় দেখা গেছে, গাড়ির ধোঁয়া থেকে দূষণের দিক দিয়ে ঢাকা তৃতীয়। এ থেকে মৃত্যুও বেশি হচ্ছে এখানে, বিশ্বের গড় মৃত্যুহারের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ। যানজটপ্রবণ এলাকাগুলোতেই বেশি দূষণ হচ্ছে। তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানমাত্রার তুলনায় প্রায় চার গুণ।
কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে ঢাকা হয়ে উঠেছিল বিশ্বের অন্যতম নির্মল বায়ুর শহর। বিধিনিষেধ ওঠার কয়েক দিনের মধ্যেই আবার এই শহর সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় এসেছে। গতকাল শনিবার কানাডার ভ্যানকুভারের পরই ঢাকার বাতাস ছিল সবচেয়ে খারাপ।
‘বিশ্বের ১০ দেশের শহরে গাড়ির ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট দূষণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদন সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনালে প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, ইথিওপিয়া, ভারত, বাংলাদেশ, চীন, ইরাক, মিসর, তানজানিয়া, কলম্বিয়া ও মালাবির ১৫ জন গবেষক এই গবেষণা করেন।
ঢাকার পাশাপাশি ভারতের চেন্নাই, ভেলোর, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, চীনের গুয়ানজু, জেংঝোউ ও নানজিং, কলম্বিয়ার বোগোটা ও মেডেলিন, ব্রাজিলের সাও পাওলো, কুরিটিবা ও লনড্রিন, মিসরের কায়রো, ইরাকের সুলায়মানিয়া, ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা, মালাবির ব্লানতাওরি ও তানজানিয়ার দারুস সালাম শহরে গবেষণাটি করা হয়।
দেখা গেছে, এসব শহরের মধ্যে গাড়ির গতি সবচেয়ে কম দারুস সালামে। সেখানে ঘণ্টায় ৯ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলে। এরপরেই রয়েছে ঢাকা, গতি ঘণ্টায় ১৪ কিলোমিটার। এই দুই শহরেই সবচেয়ে বেশি সময় মানুষ দূষিত বাতাসের মধ্যে থাকে।
গাড়ি থেকে নির্গত দূষিত বাতাসের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকির দিক থেকে ঢাকা তৃতীয় স্থানে রয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দারুস সালাম ও ব্লানতাওরি। দারুস সালামে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় আড়াইজনের মৃত্যু হয় এই দূষণে। ঢাকা ও ব্লানতাওরি শহরে মারা যায় একজন করে। যেখানে এই দূষণে বিশ্বে গড়ে ১০ লাখ মানুষে সর্বোচ্চ একজনের মৃত্যু হয়।
গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক আবদুস সালাম গণমাধ্যমকে বলেন, সামগ্রিকভাবে ঢাকায় বায়ুদূষণ বাড়ছে। কিন্তু কোন উৎস থেকে কী ধরনের দূষণ হচ্ছে, তা বুঝতে বিশ্বের জনবহুল ও মধ্যম আয়ের দেশের বড় শহরগুলোর ওপর গবেষণাটি করা হয়। রাজধানীতে বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে যানবাহনের ভূমিকা দ্রুত বাড়ছে, তাই এখন থেকে এসব উৎস বন্ধ না করলে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।
গবেষণায় গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়ায় মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণার (পিএম ২.৫) পরিমাণ বিবেচনায় নেওয়া হয়। ঢাকা শহরে বছরে গড়ে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা থাকে ৯২ মাইক্রোগ্রাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে এটা থাকার কথা ২৫ মাইক্রোগ্রাম।
মূলত পুরাতন গাড়ি, নিম্নমানের জ্বালানি, যানজট, গাড়ির গতি ও সংখ্যার ভিত্তিতে এই দূষণ বাড়ে। যাত্রী, পথচারী থেকে শুরু করে সড়কের পাশের বাসিন্দারা এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন। ঢাকার বাতাস সকালে সবচেয়ে কম ও সন্ধ্যায় সবচেয়ে বেশি দূষিত থাকে।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী, দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা পাঁচ লাখের মতো। যেগুলো থেকে কালো বিষাক্ত ধোঁয়া বের হয়। প্রতিবছর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে এ ধরনের যানবাহন বাড়ছে। ২০২০ সালের হিসাবে, দেশে নিবন্ধিত মোটরযান আছে ৪৫ লাখ ৫৮ হাজার ৮৭৮টি। এর মধ্যে ১৬ লাখ ৩০ হাজার ৩৬টি গাড়ি রয়েছে রাজধানীতে।
এখানে ১ হাজার ৬৪০ বর্গকিলোমিটারে ৩ লাখ ৩৫ হাজার গাড়ি চলে। বাসিন্দাদের প্রায় আড়াই শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে। তারা শুধু গাড়ির গ্লাস নামালে দূষণের শিকার হয়। আর বাকিরা বাস, হেঁটে ও রিকশায় চলাচল করে। তাদের প্রায় সবাই দূষণের কবলে পড়ে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ক্যামিকেল সোসাইটি দক্ষিণ এশিয়ায় কালো কার্বনের উৎস পরিমাপ শীর্ষক এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়, নরওয়েজিয়ান ইনস্টিটিউট অব এয়ার রিসার্চ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের আটজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে গবেষণাটি করা হয়। তাতেও দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী কালো কার্বন। আর এর ৫২ শতাংশ আসে জৈব জ্বালানি অর্থাৎ জ্বালানি তেল পোড়ানো ধোঁয়া থেকে।
এদিকে, গাড়ির ধোঁয়া মাপার যন্ত্র নেই বিআরটিএ’র। গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করে চোখে দেখে। অথচ বিআরটিএর ঢাকায় কোন গাড়ি চলতে পারবে, আর কোনটা পারবে না, সেই সনদ দেয়।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩২৭
আপনার মতামত জানানঃ