করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে যাবার পর গোটা বিশ্বই অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েছে যার ফলে চাকরিচ্যুত, বেতন বাকি পড়ে থাকা বা বেতন অর্ধেক হয়ে যাওয়ার মত ভোগান্তি কমবেশি পোহাতে হয়েছে সব দেশেই। তবে প্রবাসীদের ক্ষেত্রে ভোগান্তির পরিমান বেশি।
করোনা সংক্রমণের প্রভাবে গত বছর থেকে ধীরে ধীরে বেতন বাকি পড়তে থাকে প্রবাসী কর্মীদের। অর্থসংকট, করোনাভীতি সহ নানা কারণে দেশে ফিরতে থাকেন তারা। এর মধ্যে ৭৪ শতাংশকে তাদের নিয়োগকর্তা চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরতে বাধ্য করেন। চাকরি ছেড়ে আসায় পুরুষ প্রবাসী কর্মী বেতন হারিয়েছেন গড়ে এক লাখ ৯৪ হাজার টাকা, আর নারী কর্মীরা ৯৭ হাজার টাকা।
প্রবাসী কর্মীরা করোনাকালে বেতন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিকসহ গড়ে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮৯ টাকা করে হারিয়েছেন। করোনা মহামারির প্রভাবে প্রায় চার লাখ কর্মী দেশে ফিরে এসেছেন। তাদের ৮৫ শতাংশ পুরুষ কর্মী। গতকাল বুধবার (১১ আগস্ট) বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি অব মাইগ্রেশন (বিসিএসএম) এবং রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) আয়োজিত অনলাইন অনুষ্ঠানে এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়। গবেষণাটির তথ্য তুলে ধরেন বিসিএসএমের চেয়ার ও রামরুর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার।
গবেষণার তথ্যে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যের ৬টি দেশ থেকে ফিরে আসা ১ হাজার ১৬০ জন প্রবাসী কর্মীর সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে গবেষণাটি করা হয়েছে। করোনার প্রভাবে গত বছরের ফেব্রুয়ারির পর ফিরে আসা কর্মীদের মধ্যে ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ নারী। যারা চাকরিতে ছিলেন, তাদের ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ কর্মীর বেতন কমেছে আগের চেয়ে।
আর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির পর দেশে ফিরে আসার আগে নিয়মিতভাবে বেতন পাননি ৬৭ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবাসী কর্মী। তবে ফেরার আগে ৯২ শতাংশ কর্মী কোথাও কোনও অভিযোগ জানিয়ে আসেননি।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬৩ শতাংশ কর্মী দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। আবার ২৯ শতাংশ কর্মী দেশে ছুটিতে এসে আর ফিরে যেতে পারেননি। যারা বাধ্য হয়ে ফিরে এসেছেন তার ১৫ দশমিক ৬ শতাংশই কাজ হারিয়ে এসেছেন, ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ এসেছেন কাজ না থাকায়।
সরকারি হিসাব বলছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন চার লাখ কর্মী। এর মধ্যে জরিপের জন্য বেছে নেওয়া মধ্যপ্রাচ্যের ৬টি দেশ থেকেই ফিরেছেন ৮০ শতাংশ, যা প্রায় সোয়া ৩ লাখ। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ সৌদি আরব থেকে ফেরা। এর বাইরে ১৫ শতাংশ করে আরব আমিরাত ও ওমান, ১১ শতাংশ কুয়েত, ১০ শতাংশ কাতার ও ৪ শতাংশ বাহরাইন থেকে ফিরেছেন। তবে নারী কর্মীদের ৭৭ শতাংশই ফিরেছেন সৌদি আরব থেকে।
ফিরে আসার সময় ৬ মাসের বেতন বকেয়া ছিল কর্মীদের। ফিরে আসা কর্মীদের ৯৮ শতাংশই সহায়তা চান। গত বছর ফেব্রুয়ারির পর হয় চাকরি হারিয়েছেন, নয়তো বেতন কমেছে।
তবে গবেষণার পর তাদের কেউ কেউ হয়তো কর্মস্থলে ফিরে গেছেন, যা এখানে আসেনি। বেতন হারানো কর্মীদের তালিকার শীর্ষে গন্তব্য দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। এরপর আছে কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, ওমান এবং বাহরাইন।
অনালাইন এই অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন মাইগ্রেশন ফোরাম এশিয়ার জনা ইউ, বায়রার মহাসচিব শামিম আহমেদ চৌধুরী, বিএমইটি’র সাবেক পরিচালক ড. নুরুল ইসলাম, বিএনএসকে’র নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, ওয়ারবীর চেয়ারম্যান সাইদ সাইফুল হক, অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীরসহ প্রমুখ।
এদিকে ব্রাকের এ বছর এপ্রিলে করা একটি জরিপে জানা যায়, গত বছর বিদেশফেরতদের ৮৭ শতাংশ জানিয়েছিলেন- তাদের কোনো আয়ের উৎস নেই। এবারের জরিপে দেখা গেছে, উত্তরদাতাদের প্রায় ৫৩ শতাংশ কোনো না কোনো কাজে যুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৪ দশমিক ১৯ শতাংশ কৃষি কাজে, ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ দিনমজুরের বা এ ধরনের কোনো কাজে যুক্ত হয়েছেন এবং ৩৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ ছোট ব্যবসা শুরু করেছেন। এ ছাড়া ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ অন্য কোনো কাজ করছেন।
তবে উত্তরদাতাদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ২২ শতাংশ বিদেশফেরত গত এক বছরে কোনো প্রকার কাজ যোগাড় করতে পারেননি। তারা তাদের দৈনন্দিন খরচ চালাতে তাদের পরিবারের আয়ের ওপর নির্ভরশীল কিংবা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার-দেনা করে চলছেন। উত্তরদাতাদের ২৮ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা ইতোমধ্যে ধার-দেনায় জর্জরিত হয়েছেন এবং ৭২ শতাংশ জানিয়েছেন যে, তারা আবার বিদেশে চলে যেতে চান।
প্রবাসীরা চাকরিচ্যুত হওয়ায় এবং দেশে ফিরে আসায় নিজেরা যেমন ভোগান্তিতে পড়েছেন, তেমনি কমেছে রেমিটেন্সও। করোনা মহামারী সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক দুর্দশার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সকলকে এ নিয়ে উদ্বিগ্নতা কমছে না বিশেষজ্ঞদের।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১২৪৬
আপনার মতামত জানানঃ