আফগানিস্তান জুড়ে দুই পক্ষের লড়াই ও সহিংসতায় হাজারো বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। পরিস্থিতি এতটাই বিপজ্জনক যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদের দেশটি ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে। ভারত তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে আনতে উড়োজাহাজ পাঠিয়েছে। শহর জুড়ে পড়ে আছে লাশ, ছিঁড়ে খাচ্ছে কুকুর। আতঙ্কে পদত্যাগ করে পালিয়ে গেছেন আফগান অর্থমন্ত্রী। দেশটিতে বসবাসকারীরা দিন কাটাচ্ছেন মৃত্যুভয়ে। যাকে ইচ্ছা তুলে নিয়ে যাচ্ছে তালিবান। হত্যা করছে। যুদ্ধে নামিয়ে দিচ্ছে। জোর করে বিয়েও করছে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে তাদের প্রতিশ্রুতি থেকে। তালিবানের হাতে আফগানিস্তানের পতন অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে এসেছে এখন।
আফগান পরিস্থিতি
জেলের সামনে পড়ে রয়েছে গুলিবিদ্ধ মৃতদেহের স্তূপ। ওই স্তূপ থেকে একটি দেহ পাশে টেনে এনে ছিঁড়ে খাচ্ছে কতগুলো কুকুর। গত রবিবার ছয় সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে কুন্দুজ ছাড়ার আগে এই দৃশ্যই দেখেছেন ৩৬ বছরের ফ্রিবা। ওই দিনই কুন্দুজ দখল করেছে তালিবান। দেশটিতে খুঁজে বের করে খুন করা হচ্ছে আফগানিস্তানের সরকারি আধিকারিক, নিরাপত্তারক্ষীদের।
গত শনিবার তালোকান ছেড়ে পালিয়েছিলেন ২৫ বছরের বিধবা মারওয়া। তার ১৬ বছরের বোনকে তুলে নিয়ে গিয়েছে তালিবান। তার সঙ্গে কোনও এক তালিবান জঙ্গির বিয়ে দেওয়া হবে। তিনি জানাচ্ছেন, ‘‘পরিবারে দু’জন মহিলা থাকলে এক জনকে তুলে নিয়ে গিয়ে তালিবান জঙ্গির সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দু’জন পুরুষ থাকলে একজনকে জোরজবরদস্তি নিয়ে গিয়ে হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিচ্ছে।”
দীর্ঘ ২০ বছর পর আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি মাসেই প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শেষ করবে দেশটি। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা দেশটি ছাড়তে শুরু করার পরই শাসন ক্ষমতা দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে তালিবান।
এর মধ্যেই তালিবান দেশের ৮৫ শতাংশ অঞ্চল দখল নিয়ে নিয়েছে। দেশের অধিকাংশ অঞ্চলেই চলছে সংঘাত। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাতে দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, আফগানিস্তানের মোট ভূখণ্ডের ৬৫ শতাংশ তালিবানের নিয়ন্ত্রণে আছে। এ ছাড়া ১১টি প্রাদেশিক রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ তালিবানের হাতে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
আজ বুধবার আফগানিস্তানের আরো একটি প্রাদেশিক রাজধানী দখলে নিয়েছে তালিবান। তাজিকিস্তানের সীমান্তবর্তী বাদাখশান প্রদেশের রাজধানী ফয়জাবাদ সিটি দখলে নেয় সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি। এর আগে পাঁচ দিনে আফগানিস্তানের আটটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালিবান।
এর আগে মঙ্গলবার ফাইজাবাদ, পুল ই খুমরি, ফারাহ প্রদেশের রাজধানী দখল নেয় তালিবান যোদ্ধারা। এ নিয়ে ৫ দিনে ৯টি প্রাদেশিক রাজধানী এখন এ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে।
এদিকে বাঘরাম বিমানঘাটিতে রকেট হামলা চালিয়েছে তালিবান। কুন্দুজ বিমানবন্দর এখন তালিবানের নিয়ন্ত্রণে। সেখানকার নিরাপত্তায় নিয়োজিত কয়েকশ’ সেনা তালিবানের কাছে আত্মসমর্পন করেছেন।
দেশটিতে আতঙ্ক বিরাজ করছে মানুষের মধ্যে। গণহত্যা চালাচ্ছে তালিবান। সংবাদসংস্থা এএফপি-কে পুল-ই-খুমরি শহরের এক নারী জানিয়েছেন, রাস্তায় মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে। জেলগুলির বাইরে মৃতদেহের স্তূপ। ভয়ে কেউ বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন না। প্রচুর শিশুও আক্রান্ত হচ্ছে।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ সম্প্রতি একটি রিপোর্টে জানিয়েছে, আফগানিস্তানে বহু শিশু আক্রান্ত। কিন্তু সকলের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। গত এক সপ্তাহে সব মিলিয়ে প্রায় এক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলেও তারা জানিয়েছে।
গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রপুঞ্জের অভিবাসন দফতর জানিয়েছে, আফগানিস্তানে তালিবানের দখলে চলে যাওয়া প্রদেশ থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় তিন লক্ষ ৫৯ হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। অধিকাংশ মানুষই আশ্রয় নিয়েছেন কাবুলে। সেখানেই তাঁবু খাটিয়ে কোনও রকমে বেঁচে রয়েছেন তারা। কিছু দিনের মধ্যেই কাবুলে হামলা চালাতে পারে তালিবান, এই আশঙ্কায় দিন গুনছেন ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে আসা আফগানরা।
পালালেন দেশটির অর্থমন্ত্রী
আফগানিস্তানে একদিনে আরও ৩ টি প্রাদেশিক রাজধানী তালিবান নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পর আকস্মিক পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন দেশটির ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী খালিদ পায়েন্দা।
অর্থমন্ত্রীর মুখপাত্র মোহাম্মদ রাফি তাবে এ প্রসঙ্গে বলেন, তালিবানের কাস্টমস দখলের পর আফগানিস্তানের শুল্ক হ্রাস পাচ্ছে। এ কারণে অর্থমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন।
তিনি জানান, আফগানিস্তানের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা অবনতির কারণে স্ত্রীকে নিয়ে অর্থমন্ত্রী খালিদ পায়েন্দা বিদেশে চলে গেছেন।
তবে আফগান অর্থমন্ত্রী ঠিক কোন দেশে গেছেন খবরে সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। আফগানিস্তানের সাবেক এই মন্ত্রী মঙ্গলবার এক টুইট বার্তায় পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তবে ঠিক কী কারণে তিনি পদত্যাগ করছেন সে বিষয়ে কোনো কিছু বলেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
এদিকে, বিশ্বের অনেক দেশই সরাসরি অথবা ঘুরিয়ে আফগানিস্তান পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করছে। যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা অনেক।
কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মনে করেন, তার সিদ্ধান্তে কোনো ভুল নেই। যুক্তরাষ্ট্র ঠিক সময়েই আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে নিয়েছে। মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে বাইডেন জানিয়েছেন, আফগানদের লড়াই তাদেরই লড়তে হবে। যুক্তরাষ্ট্র শর্ত মেনে তাদের সাহায্য করবে।
আফগানিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছিল, যুদ্ধাস্ত্র, পোশাক, খাবার, সেনার বেতন এবং বিমান হামলায় সাহায্য করবে। সেনা সরিয়ে নেওয়ার পরেও যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানকে সেই সাহায্য করছে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি সাহায্য তাদের পক্ষে করা সম্ভব নয় বলে স্পষ্ট করে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
পশ্চিমাদের বিশ্বাসঘাতকতা
১৯৭০ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে হেরে মার্কিন বাহিনী দক্ষিণ ভিয়েতনামের সহযোগীদের ফেলে সাইগোনে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে করে যেভাবে পালিয়ে গিয়েছিল, তার আইকনিক ছবি এখনো ইন্টারনেট ভেসে বেড়ায়।
সাম্প্রতিক কালে ১৯৯১ সালে ইরাক তৎকালীন সাদ্দাম হোসেনের সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে কুর্দিদের উৎসাহিত করে পরে তাদের বিপদে ফেলে চলে গিয়েছিল মার্কিন বাহিনী। আর পশ্চিমাদের সর্বশেষ বিশ্বাসঘাতকতা দেখা গেল আজকের আফগানিস্তানে।
যে হাজার হাজার আফগান দোভাষী হিসেবে তালিবানের হুমকি উপেক্ষা করে পশ্চিমা সেনাদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন, আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের সঙ্গে পশ্চিমা সেনা ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের ভাব বিনিময়ে ভূমিকা রেখেছেন, সেই দোভাষীদের এখন মৃত্যুর মুখে ফেলে বিদেশি সেনারা নিজ দেশে চলে যাচ্ছেন।
যুক্তরাজ্যের বিশেষ বাহিনীর সঙ্গে দোভাষীর কাজ করা এক আফগান দ্য টেলিগ্রাফকে বলেছেন, ‘কয়েক হাজার দোভাষীকে তালিবান মেরে ফেলেছে। আফগানিস্তানে থাকা প্রত্যেক দোভাষীরই পরিচিত কোনো না কোনো দোভাষী তালিবানের হাতে নিহত হয়েছেন।’
আরেকজন দোভাষী টেলিগ্রাফকে বলেছেন, ‘আমি ব্রিটিশদের সঙ্গে কাজ করেছি। তারা খুবই ভালো মানুষ, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাদের মতো না। ব্রিটিশ সরকার আমাদের সঙ্গে ন্যায্য আচরণ করেনি।’
এমনকি তালিবানের হাত থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য এই দোভাষীরা এখন ভিসার আবেদন করার পর তাদের বেশির ভাগকেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ভিসা দিচ্ছে না।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯৪৩
আপনার মতামত জানানঃ