প্লাস্টিক পরিবেশের শত্রু তাই পরিবেশবাদীদের পক্ষ থেকে এর ব্যবহার নিষিদ্ধে রয়েছে জোরালো আন্দোলন। বিভিন্ন দেশে আইনগত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তার পরও বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার, যা ড্রেনেজ ব্যবস্থায় বিঘ্ন তৈরি থেকে শুরু করে মহাসমুদ্র পর্যন্ত দূষিত করে দিচ্ছে।
সমুদ্রে নদীবাহিত প্লাস্টিক দূষণে দায়ী দেশগুলোর তালিকায় নবম স্থানে আছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি এক গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। গত এপ্রিলে সায়েন্স অ্যাডভান্সে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, সমুদ্রে নদীবাহিত প্লাস্টিক দূষণে শীর্ষ দশ দেশের নয়টিই এশিয়ার। খবর ডয়েচে ভেলে
নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও নিউজিল্যান্ডের সাত গবেষকের করা এই গবেষণা বলছে, সমুদ্রের প্রায় ৮০ ভাগ প্লাস্টিক বর্জ্য আসে পৃথিবীর এক হাজারেরও বেশি নদী থেকে। এর একটি বড় অংশ আসে এশিয়ার নদীগুলো থেকে।
নতুন গবেষণা অনুযায়ী, সাগরদূষণে দায়ী দেশগুলোর যে তালিকা করা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে শীর্ষ দশে ব্রাজিল ছাড়া বাকি সব দেশ এশিয়ার। শীর্ষ ৫০টি নদীর মধ্যে এশিয়ার আছে ৪৪টি। এর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার জনবহুল এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া পাসিগ নদী দূষণের তালিকায় সবার ওপরে। এই নদী বছরে প্রায় ৬৯ হাজার টন প্লাস্টিক বহন করে সাগরে নিয়ে যাচ্ছে। দেশটি বছরে মোট ৩ লাখ ৬০ হাজার প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলে। তালিকায় দ্বিতীয় ভারত ও তৃতীয় অবস্থানে আছে চীন। ভারতের নদীগুলো বছরে ১ লাখ ৩০ হাজার টন বর্জ্য সমুদ্রে নিয়ে যায়। চীন তৈরি করে প্রায় ৭১ হাজার টন।
তালিকায় ৯ নম্বরে থাকা বাংলাদেশের নদীগুলো বছরে প্রায় ২৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে নিয়ে যায়। বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশের গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা বেসিন, কর্ণফুলী ও রূপসা নদী থেকে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য যায় বঙ্গোপসাগরে। পদ্মা দিয়ে বছরে প্রায় সাত হাজার টন, কর্ণফুলী দিয়ে প্রায় তিন হাজার টন এবং রূপসা দিয়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ে।
শীর্ষ দশে এসব দেশ ছাড়াও নাম আছে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের। শুধু এই দেশগুলোই বছরে প্রায় ৫ লাখ ৮০ হাজার টন বর্জ্য ফেলে সমুদ্রে। আশার কথা হলো, সমুদ্র পরিষ্কার করার জন্য এখন পৃথিবীতে অনেকগুলো সংস্থা কাজ করছে। তারা প্রচুর অর্থও সেখানে ব্যয় করছে। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, শুধু পরিষ্কার করাই সমাধান হতে পারে না। জনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো দিয়ে যেসব নদী বয়ে গেছে, সেসব এলাকায় পানিতে প্লাস্টিক বর্জ্য যেন না ফেলা হয় তেমন উদ্যোগ নিতে হবে।
তালিকায় ৯ নম্বরে থাকা বাংলাদেশের নদীগুলো বছরে প্রায় ২৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে নিয়ে যায়। বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশের গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা বেসিন, কর্ণফুলী ও রূপসা নদী থেকে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য যায় বঙ্গোপসাগরে।
২০১৭ সালে নেচার জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলেছিল, পৃথিবীর ২০টি বড় নদী, যার অধিকাংশই এশিয়াতে সমুদ্রের ৬৭ ভাগ প্লাস্টিক দূষণের জন্য দায়ী। তবে সায়েন্স অ্যাডভান্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা বলছে, বড় নদী নয়, বরং ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকা দিয়ে যেসব ছোট নদী গেছে, সেগুলোই মূলত এই প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে যায় বড় নদীতে এবং পরে তা সমুদ্রে পড়ে।
গবেষকদের হিসেবে, নদীগুলো বছরে কমপক্ষে ৮ লাখ টন থেকে সর্বোচ্চ ২৭ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে নিয়ে যায়। নেচারের গবেষণায় বলা হয়েছিল, এই প্রাক্কলন সাড়ে এগার লাখ থেকে ২৪ লাখ টনের কিছু বেশি।
নেচারের গবেষণায় বলা হয়েছিল, বছরে নদী থেকে সমুদ্রে যাওয়া বর্জ্যরে পরিমাণ সাড়ে ১১ লাখ থেকে ২৪ লাখ টনের বেশি। নতুন গবেষণাটিতে মোট ১ হাজার ৬৫৬টি নদীর তথ্য নিয়ে কাজ করা হয়েছে। এখানে নদীর বেসিনগুলোর নানা তথ্য, নদীর ব্যবহার সব কিছুকেই গবেষণার আওতায় আনা হয়েছে। যেমন সমুদ্রতীর থেকে নদীগুলোর দূরত্ব, বৃষ্টিপাতের প্রভাব, বাতাসের গতিবেগ, ভূমির ঢাল ও বিস্তৃতি এবং এগুলো প্লাস্টিক পরিবহনে কেমন প্রভাব ফেলে ইত্যাদি।
২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হয় বাংলাদেশে। আইনে বলা হয়, সরকার নির্ধারিত পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণে প্রথম অপরাধের দায়ে অনধিক ২ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন ২ বছর, অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অন্যূন ২ লাখ টাকা, অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন অপরাধীরা।
আইনে বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহণ বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের দায়ে অনধিক ১ (এক) বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের দায়ে অন্যূন ২ বছর, অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অন্যূন ২ লাখ টাকা, অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন অপরাধীরা।
একই সালের ৪ মে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশের এস আই/সমপর্যায় থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অব পুলিশ পর্যন্ত; মেট্রোপলিটনবহির্ভূত এলাকায় এসআই/সমপর্যায় থেকে সহকারী পুলিশ সুপার পর্যন্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের ‘পরিদর্শকের’ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
এ আইন তৈরির ১৮ বছর পরও আইন মানার ক্ষেত্রে ও তা বাস্তবায়নে কোনো সদিচ্ছা দেখা যায়নি। যে কোনো কাঁচাবাজারে গেলেই দেখা যাবে প্লাস্টিকের ব্যাগের দোকান। প্লাস্টিকের একবার ব্যবহারযোগ্য পণ্যের বাজার বাড়ছে প্রতিদিনই। প্রতি বছর দুই হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক কাঁচামাল আমদানি করে বাংলাদেশ। আর প্রতি বছর ২৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিতে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের ওপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা পালনে দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করা দরকার।
তারা বলেন, সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ প্রশাসন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এবং জবাবদিহিতার অভাব ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। একইসঙ্গে রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা।
তারা বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার কি বাড়বে? আমরা অনায়াসে বলতে পারি বাড়বে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়েই বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। তারা বলেন, অর্থনীতিতে যত বেশি প্রবৃদ্ধি আসছে প্লাস্টিকের ব্যবহারও বাড়ছে। প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে নির্মাণে, অবকাঠামো উন্নয়নে, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস শিল্পে এবং পরিবহনে।
তারা বলেন, আপনার ছোট ছোট পদক্ষেপে সমুদ্র দূষণ কমতে পারে। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং চারপাশের মানুষকেও সমুদ্রের গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে হবে। সমুদ্রে বেড়াতে গেলে আমরা জেনে বা না বুঝে বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটসহ বোতল বা প্লাস্টিক ইত্যাদি পানিতে ফেলে দূষিত করি। এবিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৩
আপনার মতামত জানানঃ