তথ্য আর বাস্তবতার অমিল এদেশে নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। আর চিকিৎসাখাতের সরকারি তথ্যে অসঙ্গতি যেন অবধারিত নিয়তি। করোনা সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করার পর দেশের অবস্থা যখন নাজুক, তখনও এর ব্যতিক্রম হয়নি বরং বেড়েছে।
তথ্যের সব থেকে বড় গোঁজামিল আইসিইউ নিয়ে। করোনা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা না থাকলেও অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যে দেখানো হচ্ছে যে আইসিউ শয্যা আছে, ফাঁকা আইসিউ বেডের সংখ্যাও কম দেখানো হচ্ছে। পাশাপাশি রোগীর সংখ্যা নিয়েও চলছে তথ্য বিভ্রাট। রোগী থাকলেও তালিকায় নাম থাকছে না বেশিরভাগের।
আইসিইউ বেডের সংখ্যা নিয়ে ভুল তথ্য দিচ্ছে অধিদপ্তর
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে ভোলা, কুষ্টিয়া, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, জামালপুর— এই পাঁচ জেলার হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য ২০টি আইসিইউ রয়েছে। বাস্তবে এসব হাসপাতালে গতকাল রোববার পর্যন্ত সচল কোনো আইসিইউ শয্যাই ছিল না।
গতকালকের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ৬টি আইসিইউ চালু রয়েছে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সেখানে আইসিইউ শয্যা রয়েছে, কিন্তু কোনোটিই এখনো চালু করা যায়নি।
ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্ববধায়ক সিরাজউদ্দিন এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, ছয়টি আইসিইউ আছে, এসব চালানোর মতো লোকবল নেই। হাসপাতাল ২৫০ শয্যার হলেও লোকবল ৫০ শয্যার কম।
এদিকে প্রশিক্ষিত জনবল আর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় আইসিইউ সেবা চালু করা যায়নি পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যদিও করোনা রোগীদের চিকিৎসায় হাসপাতালটিতে তিন মাস আগে পাঁচটি আইসিইউ শয্যা দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। হাসপাতালের একটি আইসিইউ ইউনিটও প্রস্তুত করা হয়। বাধ্য হয়ে গুরুতর রোগীদের ছুটতে হয় ৪০ কিলোমিটার দূরের বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (নিটোর) একটি করোনা ইউনিট চালু করা হলেও নেই আইসিইউ শয্যা। যদিও অধিদপ্তরের হিসাবে এই ইউনিটে ৩টি আইসিইউ রয়েছে। তবে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল গণি মোল্লা ঐ জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘অধিদপ্তর বলায়, একটি করোনা ইউনিট চালু করা হয়েছে। কোনো আইসিইউ এই হাসপাতালে নেই।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিনের বিজ্ঞপ্তিতে দেশের ৯৬টি সরকারি হাসপাতালের সাধারণ ও আইসিইউ শয্যা, ভর্তি রোগী, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা ও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থার তথ্য থাকে। গতকাল এক শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধিরা এসব হাসপাতালের তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
ফাঁকা আইসিউ বেডের তথ্যও বেশি দেখানো হচ্ছে
সঠিক তথ্য প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি প্রশাসনে। প্রকৃত চিত্র না দেখানোর একটা প্রবণতা অনেকের মধ্যে কাজ করে। তথ্য আড়াল করা জনগণের জন্য খারাপ, সরকারের জন্যও খারাপ।
অধিদপ্তরের হিসাবে, এসব হাসপাতালে গতকাল শয্যা ছিল ১৩ হাজার ৭৯৮টি। প্রথম আলোর সংগ্রহ করা তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে শয্যা ১৩ হাজার ৪৬৫টি। অধিদপ্তরের হিসাবে, ৭৫০টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ৭৪টি গতকাল ফাঁকা ছিল। সূত্র মতে, ৭১৮টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ফাঁকা ছিল ২২টি।
আবার সিলেট জেলায় করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত চারটি সরকারি হাসপাতালে গতকাল চিকিৎসাধীন রোগী ছিলেন ৪৩৬ জন। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, এই জেলায় গতকাল চিকিৎসাধীন করোনা রোগীর সংখ্যা দেখানো হয় ১৩৬ জন।
রোগী থাকলেও তালিকায় নাম নেই
গাজীপুরে করোনা রোগীদের চিকিৎসা হয় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ ফজিলাতুন্নেছা মেমোরিয়াল কেপিজে হাসপাতালে। শেখ ফজিলাতুন্নেছা হাসপাতালে ১০০ শয্যার সক্ষমতা থাকলেও অক্সিজেন–স্বল্পতার জন্য গতকাল পর্যন্ত ৪২টি শয্যা চালু করা গেছে।
এই হাসপাতালটিতে গতকাল ৪২টি শয্যার বাইরেও আরও ৮ জন রোগী ভর্তি ছিল। তবে অধিদপ্তরের হাসপাতালের তালিকায় ফজিলাতুন্নেছা হাসপাতালের নাম নেই।
সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ৩২৫টি শয্যা রয়েছে। গতকাল এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ২৯৭ জন।
এ ছাড়া শহরের শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল, ৩১ শয্যার খাদিমপাড়া হাসপাতাল এবং দক্ষিণ সুরমা ৩১ শয্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও করোনা রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের নাম নেই।
এদিকে বিভিন্ন জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত জেলা সদর বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে এখন অনেক রোগী ভর্তি। কিন্তু অধিদপ্তর শুধু জেলা বা মেডিকেল কলেজের তথ্য বিজ্ঞপ্তিতে যুক্ত করছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের নির্ধারিত করোনা হাসপাতাল ছাড়াও তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সম্প্রতি ৬৬ শয্যা চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩০ শয্যার করোনা ওয়ার্ডে ১১ জন ও জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৬ শয্যার করোনা ওয়ার্ডে ১০ জন করোনা আক্রান্ত রোগী গতকাল ভর্তি ছিলেন।
করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে উপসর্গযুক্ত অনেক রোগী সেবা নিচ্ছেন। অনেক হাসপাতালে শনাক্ত রোগীর চেয়ে উপসর্গযুক্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি। মানিকগঞ্জে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালের শয্যা ১০০টি। গতকাল সেখানে ২৫১ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে ৯৫ জন করোনা পজিটিভ এবং বাকি ১৫৬ জন উপসর্গযুক্ত রোগী।
নওগাঁ জেলায় করোনা চিকিৎসায় নির্ধারিত কোনো হাসপাতাল নেই। তবে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালসহ জেলার ১০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ২০১টি শয্যা রয়েছে। এসব শয্যায় গতকাল ৪৫ জন করোনা পজিটিভ রোগী এবং উপসর্গ নিয়ে ১১৮ জন রোগী ভর্তি ছিলেন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, সঠিক তথ্য প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি প্রশাসনে। প্রকৃত চিত্র না দেখানোর একটা প্রবণতা অনেকের মধ্যে কাজ করে। ব্যবহারের অযোগ্য আইসিইউ শয্যা সরকারি তালিকায় সচল হিসেবে দেখানোর কোনো যুক্তি নেই। কোথাও কোনো ঘাটতি থাকলে তা জানানো উচিত। এতে ঘাটতি দূর করা বা ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়। তথ্য আড়াল করা জনগণের জন্য খারাপ, সরকারের জন্যও খারাপ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে বিভিন্ন হাসপাতালের শয্যার মিল না পাওয়ার বিষয়ে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা জানান, শয্যা ফাঁকা বা পূর্ণ থাকার তথ্য সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর দেওয়া। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা জানায়। আর যে তথ্য প্রতিদিন অধিদপ্তর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়, তা ২৪ ঘণ্টা আগের তথ্য।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, মহামারি পরিস্থিতি মূল্যায়ন, প্রক্ষেপণ, নীতিনির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সঠিক তথ্য দরকার। আস্থাহীন পরিবেশ মহামারি নিয়ন্ত্রণের সহায়ক হতে পারে না। এর ফলে মানুষ সরকারের ভালো উদ্যোগেও সাড়া দিতে দ্বিধা করতে পারে। লকডাউন বা যেকোনো উদ্যোগে মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হলে সঠিক তথ্য দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ